Foundation Series, বিজ্ঞান ও পরিবেশ, বিষয়: চুম্বক (Magnet)
Sanya
September 30, 2018
0 Comments
চুম্বক (Magnet):
যে সমস্ত বস্তু লোহা, নিকেল ও কোবাল্ট ইত্যাদি চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং যার দিগ্দর্শী ধর্ম আছে, তাকে চুম্বক বলে।
চৌম্বক পদার্থ:
যে সমস্ত পদার্থ চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং যাদেরকে কৃত্রিম উপায়ে চুম্বকে পরিণত করা যায়, তাদের চৌম্বক পদার্থ বলে। যেমন, কাঁচা লোহা, ইষ্পাত, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি হল চৌম্বক পদার্থ।
চুম্বকত্ব:
যে ধর্মের জন্য কোনো চুম্বক, চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং দিক নির্দেশ করতে পারে, সেই ধর্মকে চুম্বকের চুম্বকত্ব বলে। এই চুম্বকত্ব পদার্থের একটি ভৌত ধর্ম। কারণ এই ধর্মের জন্য পদার্থের অণুর গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না।
চুম্বকের প্রকারভেদ: উৎসের বিচারে চুম্বককে দুইভাগে ভাগ করা যায়:
(i) প্রাকৃতিক চুম্বক
(ii) কৃত্রিম চুম্বক
প্রাকৃতিক চুম্বক (Natural Magnet):
প্রকৃতিতে লোহা ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরি ম্যাগনেটাইট পাথর পাওয়া যায়, যার মধ্যে চুম্বকত্ব ধর্ম দেখা যায়, অর্থাৎ লোহা, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদিকে আকর্ষণ করতে পারে এবং দিগ্দর্শী ধর্মও আছে, তাকে প্রাকৃতিক চুম্বক বা লোডস্টোন বলে। এর রাসায়নিক সংকেত \(F{e_3}{O_4}\)।
এই প্রাকৃতিক চুম্বকের নির্দিষ্ট কোনো আকার থাকে না। তাছাড়া এর আকর্ষণী ক্ষমতাও অনেক কম হয়।
কৃত্রিম চুম্বক (Artificial Magnet):
লোহা, ইষ্পাত , কোবাল্ট , নিকেল বা এদের বিভিন্ন সংকর ধাতুকে কয়েকটি বিশেষ পদ্ধতিতে চুম্বকে পরিণত করা হলে, ওই চুম্বককে কৃত্রিম চুম্বক বলে।
প্রাকৃতিক চুম্বকের নির্দিষ্ট কোনো জ্যামিতিক আকার বা আকৃতি নেই এবং প্রাকৃতিক চুম্বকের চৌম্বক শক্তিও অনেক কম ও দিগ্দর্শী ধর্মও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিশেষ আকার বিশিষ্ট শক্তিশালী চুম্বকের প্রয়োজন হয়। এইজন্য কৃত্রিম উপায়ে নানান আকারের চুম্বক প্রস্তুত করা হয়। এগুলিই কৃত্রিম চুম্বক।
আবার কোনও চুম্বকের চুম্বকত্ব স্থায়িত্বের উপর নির্ভর করে চুম্বককে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
(1) স্থায়ী চুম্বক (Parmanent Magnet):
যে সমস্ত কৃত্রিম চুম্বকের চুম্বকত্ব অনেকদিন বজায় থাকে, সহজে নষ্ট হয় না, তাদের স্থায়ী চুম্বক বলে। যেমন: দন্ড চুম্বক, অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক, চুম্বক শলাকা ইত্যাদি হল স্থায়ী চুম্বক।
(2) অস্থায়ী চুম্বক (Temporary Magnet):
যে সমস্ত কৃত্রিম চুম্বকের চুম্বকত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় না, তাদের অস্থায়ী চুম্বক বলে।
যেমন, কাঁচা লোহার দন্ডকে ঘর্ষণ প্রণালীতে চুম্বকে পরিণত করা হলে যদিও বেশ শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয়, কিন্তু ওই চুম্বকের চুম্বকত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
বিভিন্ন ধরণের চুম্বক:
ব্যবহারের সুবিধার জন্যবিভিন্ন আকারের কৃত্রিম চুম্বক তৈরি করা হয়।
(1) দন্ডচুম্বক (Bar Magnet):
আয়তঘনক আকারের কোনো ইষ্পাতদন্ডকে চুম্বকে পরিণত করা হলে, তাকে দন্ডচুম্বক বলে।
পরীক্ষাগারে বিভিন্ন কাজে এই ধরণের চুম্বক ব্যবহার করা হয়।
(2) চুম্বকশলাকা (Magnetic Needle):
এটি চুম্বকিত ইষ্পাতের তৈরি একটি পাতলা পাত যার দুইপ্রান্ত ছুঁচালো থাকে। পাতটির মধ্যবিন্দু একটি সোজা দন্ডের ছুঁচালো মুখের ওপর এমনভাবে বসানো থাকে যাতে শলাকাটি অনুভূমিক তলে অবাধে ঘুরতে পারে। একে চুম্বকশলাকা বলে।
(3) অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক (U-Shaped Magnet):
ইংরেজী U অক্ষরের মতো বাঁকানো ইষ্পাতদন্ডকে চুম্বকে পরিণত করলে সেই চুম্বককে অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক বলে। এই চুম্বকের দুটি মেরু খুব কাছাকাছি থাকে।
(4) গোলক-মুখযুক্ত চুম্বক (Dumbel-Shaped Magnet):
যে দন্ডচুম্বকের দুইপ্রান্তে দুটি গোলক যুক্ত থাকে, তাকে গোলক-মুখযুক্ত চুম্বক বলে। এটি দেখতে ডাম্বেলের মতো হয়।
(5) তড়িৎচুম্বক (Electromagnet):
কাঁচালোহার তৈরি একটি দন্ডের ওপর অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে, ওই তারদুটির দুইপ্রান্তে সমপ্রবাহ তড়িৎ চালনা করলে, ওই দন্ডটি একটি শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয়। যতক্ষণ তড়িৎপ্রবাহ বজায় থাকে ততক্ষণ দন্ডটির চুম্বকত্ব স্থায়ী হয়। তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করলেই এর চুম্বকত্ব আর থাকে না।
(6) মেরুবিহীন চুম্বক:
কাঁচালোহার তৈরি একটি আংটা বা বৃত্তাকার বলয়ের গায়ে অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে ওই তারের মধ্যে সমপ্রবাহ তড়িৎ চালনা করলে বলয়টি একটি চুম্বকে পরিণত হয়। এই চুম্বকের কোনও মেরু থাকে না। একে মেরুবিহীন চুম্বক বলে।
এখন এই চুম্বকের যে কোনও স্থান কেটে ফেললে, ওই স্থানের দুই বিপরীত প্রান্তে দুটি মেরুর সৃষ্টি হয়।
প্রাকৃতিক চুম্বক ও কৃত্রিম চুম্বকের মধ্যে পার্থক্য:
চুম্বকের ধর্ম (Property of Magnet):
প্রত্যের চুম্বকেরই দুটি বিশেষ ধর্ম আছে।
(1) আকর্ষণী ধর্ম (Attractive Property):
(2) দিগ্দর্শী ধর্ম (Directive Property):
আকর্ষণী ধর্ম:
যে ধর্মের জন্য চুম্বক লোহা, নিকেল, কোবাল্ট বা এদের সংকর ধাতুকে আকর্ষণ করতে পারে, তাকে চুম্বকের আকর্ষণী ধর্ম বলে। কিন্তু এই আকর্ষণী ধর্ম চুম্বকের দৈর্ঘ্য বরাবর সব জায়গায় সমান হয় না।
দিগ্দর্শী ধর্ম:
কোনো দন্ডচুম্বককে বাধাহীনভাবে ঝুলিয়ে দিলে এটি উত্তর-দক্ষিন বরাবর মুখ করে থাকে। দন্ডচুম্বকের এই ধর্মকে দিগ্দর্শী ধর্ম বলে।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা:
(1) চুম্বক মেরু (Magnetic Pole):
কোনো চুম্বকের দুইপ্রান্তের কাছাকাছি যে দুই বিন্দুতে চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, সেই বিন্দু দুটিকে চুম্বকের মেরু বা চুম্বক-মেরু বলে।
একটি দন্ডচুম্বককে একটি পাকহীন সুতোর সাহায্যে মুক্ত অবস্থায় অনুভূমিকভাবে ঝুলিয়ে দিলে চুম্বকের যে মেরুটি মোটামুটি উত্তরদিকে মুখ করে থাকে, তাকে উত্তর সন্ধানী মের বা উত্তর মেরু (N) এবং যে মেরুটি দক্ষিন দিকে মুখ করে থাকে, তাকে দক্ষিন সন্ধানী মেরু বা দক্ষিন মেরু (S) বলে। চুম্বকের উত্তরমেরুকে N এবং দক্ষিন মেরুকে S অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
চুম্বকের মেরুদুটি, চুম্বকের একবারে প্রান্ত থাকে না। চুম্বকের মধ্যে প্রান্তের কাছাকাছি কোনো বিন্দুতে থাকে। চুম্বক মেরুর আকর্ষণ ক্ষমতার পরিমাপকে ওই চুম্বকের মেরুশক্তি বলে। যেকোনো চুম্বকের উভয় মেরুর মেরুশক্তি সবসময় সমান হয়।
চৌম্বক অক্ষ (Magnetic axis):
কোনো চুম্বকের মেরু দুটির সংযোজক সরলরেখাকে চৌম্বক অক্ষ বলে।
চৌম্বকদৈর্ঘ্য (Magnetic Length):
কোনো চুম্বকের দুই মেরুর মাঝের দূরত্বকে চৌম্বক দৈর্ঘ্য বলে। এই চৌম্বক দৈর্ঘ্য, চুম্বকের প্রকৃত জ্যামিতিক দৈর্ঘ্যের চেয়ে কিছুটা কম হয়।
কোনো চুম্বকের প্রকৃত দৈর্ঘ্য L হলে, ওর চৌম্বক দৈর্ঘ্য হয় NS = 0.86L
চৌম্বক মধ্যতল (Magnetic Meridian):
কোনো স্থানে বাধাহীনভাবে ঝোলানো একটি চুম্বকের স্থির অবস্থানে, ওই চুম্বকের চৌম্বক অক্ষ বরাবর যে উল্লম্ব তল কল্পনা করা যায়, তাকে ওই স্থানের চৌম্বক মধ্যতল বলে।
উদাসীন অঞ্চল (Neutral Region):
কোনো দন্ডচুম্বকের ঠিক মাঝখানে, চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতা প্রায় থাকেই না। চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতাহীন এই অঞ্চলকে উদাসীন অঞ্চল বলে।
নিরপেক্ষ রেখা (Neutral Line):
চৌম্বক অক্ষের মধ্যবিন্দু দিয়ে চৌম্বক অক্ষের ওপর লম্ব টানলে ওই লম্বরেখার যে অংশ চুম্বকের মধ্যে থাকে, তাকে নিরপেক্ষ রেখা বলে।
চৌম্বকক্ষেত্র (Magnetic Field):
একটি চুম্বককে কোনো একটি স্থানে রাখলে, ওই চুম্বকের চারপাশের যে স্থান জুড়ে চুম্বকের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল কাজ করে, তাকে ওই চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র বলে।
কোনো চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তৃতি, ওই চুম্বকের মেরুশক্তির ওপর নির্ভর করে। গাণিতিক হিসাবে একটি চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু বাস্তবে চৌম্বকক্ষেত্র চুম্বকটির চারিদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
চুম্বকের দুটি বিশেষ ধর্ম:
(1) চুম্বকের সমমেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে:
পরীক্ষা:
একটি চুম্বক শলাকা এবং উত্তর (N) ও দক্ষিন (S) মেরু চিহ্নিত একটি দন্ডচুম্বক নেওয়া হল। একটিদন্ডচুম্বকের উত্তরমেরুকে, চুম্বকশলাকার উত্তরমেরুর কাছে আনা হল। দেখা যাবে যে, চুম্বক শলাকার উত্তর মেরুটি দূরে সরে গেলো।
এবার দন্ডচুম্বকের দক্ষিন মেরুকে, চুম্বক শলাকার দক্ষিন মেরুর কাছে আনা হল। দেখা যাবে যে, চুম্বক শলাকার দক্ষিন মেরুটি দূরে সরে গেলো।
অর্থাৎ বলা যায় চুম্বকের সমমেরু দুটি পরস্পর পরস্পরকে বিকর্ষণ করে।
এবার দন্ডচুম্বকটির দক্ষিন (S) মেরুকে, চুম্বকশলাকার উত্তরমেরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। দেখা যাবে যে, চুম্বক শলাকার উত্তরমেরু, দন্ডচুম্বকের দক্ষিন মেরুর কাছে সরে এলো। অনুরূপভাবে, দন্ডচুম্বকের উত্তরমেরুকে (N), চুম্বকশলাকার দক্ষিনমেরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। দেখা যাবে যে, চুম্বকশলাকার দক্ষিন মেরু, দন্ডচুম্বকের উত্তরমেরুর কাছে সরে এলো।
অর্থাৎ, চুম্বকের বিপরীত মেরু দুটি পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
সিদ্ধান্ত:
এর থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, চুম্বকের সমমেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং চুম্বকের বিপরীত মেরু পরষ্পরকে আকর্ষণ করে।
(2) আকর্ষণের চেয়ে বিকর্ষণই চুম্বকত্বের প্রকৃষ্ট প্রমান:
(i) দুটি চুম্বকের সমমেরু পরষ্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত মেরু পরষ্পরকে আকর্ষণ করে। আবার কোনো চুম্বকের উভয়মেরুই চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে, বিকর্ষণ করে না।
সুতরাং, যদি কোনোও চুম্বকের একটি মেরু পরীক্ষাধীন কোনও বস্তুকে আকর্ষণ করে, তবে দুইরকম সিদ্ধান্ত করা যায়। যেমন:
(a) বস্তুটির যে প্রান্ত আকৃষ্ট হচ্ছে, সেই প্রান্তটিতে আকর্ষণকারী মেরুর বিপরীত মেরু বর্তমান। অর্থাৎ পরীক্ষাধীন বস্তুটি চুম্বক আবার,
(b) পরীক্ষাধীন বস্তুটি চৌম্বক পদার্থ (লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট)।
সুতরাং কোনও চুম্বক ও পরীক্ষাধীন বস্তুর মধ্যে কেবলমাত্র আকর্ষণ দেখে বস্তুটি চুম্বক কিনা তা বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু, কোনও চুম্বকের একটি মেরু যদি পরীক্ষাধীন কোনো বস্তুকে বিকর্ষণ করে তবে নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, পরীক্ষাধীন বস্তুর বিকর্ষিত প্রান্তে চুম্বকটির সমমেরু বর্তমান। অর্থাৎ পরীক্ষাধীন বস্তুটি একটি চুম্বক, চৌম্বক পদার্থ নয়। সুতরাং বিকর্ষণই চুম্বকত্বের প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
চুম্বকন পদ্ধতি (Method of Magtetisation):
চৌম্বক পদার্থকে কৃত্রিম উপায়ে চুম্বকে পরিণত করার পদ্ধতিতে চুম্বকন পদ্ধতি বলে।
কোনো চৌম্বক পদার্থকে প্রধাণত দুটি উপায়ে কৃত্রিম চুম্বকে পরিণত করা হয়। যথা:
(1) ঘর্ষণ প্রণালী:
(2) বৈদ্যুতিক প্রণালী:
ঘর্ষণ পদ্ধতিতে তিনরকম উপায়ে কোনো চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করা যায়। যথা:
(1) একক-স্পর্শ প্রণালী
(2) পৃথক-স্পর্শ প্রণালী
(3) যুগ্ম-স্পর্শ প্রণালী
এখানে মূলত বৈদ্যুতিক প্রণালীতে কিভাবে একটি চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করা যায় তার আলোচনা করা হল।
বৈদ্যুতিক প্রণালী:
এই পদ্ধতিতে কাঁচা লোহার দন্ডের ওপর অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে ওই তারের মধ্য দিয়ে সমপ্রবাহ তড়িত (DC) পাঠালে, ওই লোহার দন্ডটি একটি চুম্বকে পরিণত হয়। এবং তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করলে চুম্বকটির চৌম্বকত্ব লোপ পায়। এই ধরনের চুম্বককে তড়িৎচুম্বক বলে।
তড়িৎচুম্বক (Electromagnet):
একটি কাঁচালোহার দন্ডের ওপর অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে, ওই তারের মধ্য দিয়ে সমপ্রবাহ তড়িৎ (DC) চালনা করলে, ওই লোহার দন্ডটি একটি চুম্বকে পরিণত হয়। এবং তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করলেই চুম্বকটির চৌম্বকত্ব লোপ পায়। এই ধরণের চুম্বককে তড়িৎচুম্বক বলে।
অশ্বখুরাকৃতি তড়িৎচুম্বক (U-Shaped Magnet):
অশ্বখুরাকৃতি তড়িৎচুম্বক তৈরি করতে গেলে প্রথমে একটি "U" আকারের কাঁচা লোহার দন্ড নেওয়া হয়। ওই লোহার দন্ডের দুই বাহুর ওপর অন্তরিত তামার তার বিপরীত পাকে জড়ানো হয়। এবার ওই অন্তরিত তামার তারের দুইপ্রান্তে সমপ্রবাহ তড়িৎ (DC) চালনা করা হলে "U" আকারের দন্ডটি একটি শক্তিশালী তড়িৎচুম্বকে পরিণত হয়। একে অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক বলে। এই অশ্বখুরাকৃতি চুম্বকে মেরুদুটি খুব কাছাকাছি থাকায়, এই চুম্বক খুব শক্তিশালী হয়।
তড়িৎচুম্বকের কোন্ প্রান্তে কোন্ মেরু সৃষ্টি হবে তার প্রকৃতি নির্ণয়:
কোনো তড়িৎচুম্বকের দন্ডের যেকোনও একটি প্রান্তের দিকে তাকালে, ওই প্রান্তে তারের পাক যদি ঘড়ির কাঁটার দিকে হয় অর্থাৎ দক্ষিণাবর্তী হয়, তাহলে ওই প্রান্তে দক্ষিণমেরুর (S) সৃষ্টি হবে। আবার তড়িৎচুম্বকের দন্ডের যে প্রান্তে তারের পাক ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী হয় অর্থাৎ বামাবর্তী হয় তাহলে ওই প্রান্তে উত্তরমেরুর (N) মেরুর সৃষ্টি হবে।
একটি তড়িৎচুম্বকের শক্তি কোন্ কোন্ উপায়ে বাড়ানো যায়?
(1) একটি তড়িৎচুম্বকে অন্তরিত তামার তারের পাকসংখ্যা বাড়িয়ে তড়িৎচুম্বকের শক্তি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়।
(2) একটি তড়িৎচুম্বকের মধ্য দিয়ে সমপ্রবাহমাত্রার মান বাড়িয়ে তড়িৎচুম্বকের শক্তি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়।
(3) তড়িৎচুম্বকে ইষ্পাতের পরিবর্তে কাঁচালোহা ব্যবহার করলে তড়িৎচুম্বকের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
তড়িৎচুম্বকের ব্যবহার:
(1) কলকারখানা অথবা বন্দরে লোহার ভারী বস্তুকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাতে তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করা হয়।
(2) ইলেকট্রিক কলিং বেল, টেলিগ্রাফ, বৈদ্যুতিক মোটর ও ডায়নামো, বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক ট্রেন ইত্যাদি যন্ত্রে তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করা হয়।
(3) চোখে লোহার কুচি বা গুঁড়ো পড়লে তা বের করতে ডাক্তাররা সূক্ষাগ্র মেরুযুক্ত তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করেন।
(4) টেলিফোন, মাইক্রোফোন, লাউডস্পীকার ইত্যাদি যন্ত্রে তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করা হয়।
সাধারণ চুম্বক ও তড়িৎচুম্বকের মধ্যে পার্থক্য:
চৌম্বক আবেশ (Magnetic Induction):
একটি শক্তিশালী চুম্বককে কোনো চৌম্বক পদার্থের (লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট) কাছে আনলে বা স্পর্শ করালে চৌম্বক পদার্থটি সাময়িকভাবে চুম্বকে পরিণত হয়। এখন যদি চুম্বকটিকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে চৌম্বক পদার্থটি তার চুম্বকত্ব হারায়। এই ঘটনাকে চৌম্বক আবেশ বলে।
সংজ্ঞা (Definition):
কোনো চৌম্বক পদার্থকে একটি শক্তিশালী চুম্বক মেরুর কাছে আনলে বা তার চুম্বক মেরুতে স্পর্শ করালে চৌম্বক পদার্থটি সাময়িকভাবে চুম্বককত্ব লাভ করে। এখন চুম্বকটিকে সরিয়ে নেওয়া হলে, চৌম্বক পদার্থটির চম্বকত্ব হারায়। এই ঘটনাকে চৌম্বক আবেশ বলে।
আবেশকারী চুম্বক:
যে চুম্বকের সাহায্যে চৌম্বক পদার্থটি সাময়িকভাবে চুম্বকে পরিণত হয়, তাকে আবেশকারী চুম্বক বলে।
আবেশকারী মেরু:
আবেশকারী চুম্বকের যে মেরু চৌম্বক পদার্থের কাছে থাকে, তাকে আবেশকারী মেরু বলে।
আবিষ্ট চুম্বক:
আবেশের ফলে যে চৌম্বক পদার্থটি চুম্বকে পরিণত হয়, তাকে আবিষ্ট চুম্বক বলে।
আবিষ্ট মেরু:
চৌম্বক আবেশের ফলে চৌম্বক পদার্থের দুইপ্রান্তে যে দুই মেরুর সৃষ্টি হয়, তাদের আবিষ্ট মেরু বলে।
আবিষ্ট চুম্বকত্ব:
আবেশের ফলে কোনো চৌম্বক পদার্থ সাময়িকভাবে যে চুম্বকত্ব লাভ করে, তাকে আবিষ্ট চুম্বকত্ব বলে। আবেশকারী চুম্বক সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্ট চুম্বকত্ব লোপ পায়। অর্থাৎ আবিষ্ট চুম্বকত্ব অস্থায়ী।
আবিষ্ট চুম্বকের মেরুর প্রকৃতি:
চৌম্বক আবেশের ফলে আবিষ্ট চুম্বকে, আবেশকারী মেরুর নিকটতম প্রান্তে বিপরীত মেরু এবং দূরতম প্রান্তে সমমেরুর সৃষ্টি হয়।
আকর্ষণের পূর্বে আবেশ হয় - কথাটি ব্যাখ্যা করো:
চুম্বকের একটি মেরুকে কোনো চৌম্বক পদার্থের কাছে আনলে চৌম্বক আবেশের ফলে চৌম্বক পদার্থের নিকটতম প্রান্তে আবেশকারী মেরুর বিপরীত মেরু এবং দূরপ্রান্তে সমমেরুর সৃষ্টি হয়।
ফলে আবেশকারী মেরু এবং আবিষ্ট নিকট মেরুর মধ্যে একটি আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে। অবশ্য একই সঙ্গে আবেশকারী মেরু এবং দূরপ্রান্তের আবিষ্ট সমমেরুর মধ্যেও বিকর্ষণ বলও ক্রিয়া করে। কিন্তু এদের মধ্যে দূরত্ব বেশি হওয়ায় বিকর্ষণ বল, আকর্ষণ বলের চেয়ে কম হয়। ফলে চুম্বকটি ওই চৌম্বক পদার্থকে নিজের দিকেই আকর্ষণ করে।তাই বলা হয় - আকর্ষণের পূর্বে আবেশ হয়।
প্রত্যেক চুম্বকে সর্বদা দুটি মেরু থাকবেই - একক মেরুর অস্থিত্ব সম্ভব নয়:
একটি দন্ডচুম্বকের দুইপ্রান্তে দুটি মেরু বর্তমান থাকে। ওই চুম্বকের মাঝখানে চৌম্বক ধর্ম থাকে না বল্লেই চলে। তাই মনে হতে পারে, একটি দন্ডচুম্বককে ভেঙে দুইটুকরো করলে দুটি অংশে একটি করে মেরু পাওয়া যাবে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, উভয় খন্ডই দুই মেরু বিশিষ্ট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বক। এই টুকরো দুটিকে যদি আবার অর্ধেক করা হয়, তখন প্রতিটি টুকরোই আবার দুই মেরু বিশিষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বক হবে। এইভাবে চুম্বককে ভেঙে যত ছোটই করা হোক না কেন তার দুইপ্রান্তে সর্বদা দুটি মেরু পাওয়া যাবে। সুতরাং বলা যায় যে - চুম্বকের দুই মেরু বিপরীতধর্মী হলেও অবিচ্ছেদ্য। অর্থাৎ একক মেরু বিশিষ্ট চুম্বক পাওয়া সম্ভব নয়।
চুম্বকের আণবিক তত্ত্ব:
একটি চুম্বককে ভেঙে যতই ছোটো করা হোক না কেন, তার দুইটি মেরুকে কখনোই পৃথক করা যায় না। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়েবার (Weber) সর্বপ্রথম চুম্বকত্বের আণবিক মতবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, চুম্বকত্ব, চৌম্বক পদার্থের একটি আণবিক ধর্ম। প্রতিটি চৌম্বক পদার্থের প্রতিটি অণুর দুইপ্রান্তে দুইমেরু বিশিষ্ট এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে। এই অণুচুম্বকগুলিকে "ওয়েবার উপাদান (Webwe)" বলে। চৌম্বক পদার্থের চুম্বকত্ব সম্পর্কে ওয়েবারের এই মতবাদকে চুম্বকের আণবিক তত্ত্ব বলে।
(1) ওয়েবারের ধারণা অনুযায়ী সাধারণ অবস্থায় চৌম্বক পদার্থের অণুচুম্বকগুলি চারিদিকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকে। ফলে যেকোনো একটি অণুচুম্বকের মেরুর ক্রিয়া, অপর একটি অণুচুম্বকের মেরুর ক্রিয়াকে প্রশমিত করে। তাই সাধারণ অবস্থায়, চৌম্বক পদার্থের মধ্যে চৌম্বক ধর্ম প্রকাশ করা যায় না।
(2) চৌম্বক পদার্থকে যখন কোনো শক্তিশালী চুম্বকের সাহায্যে বা তড়িৎশক্তির সাহায্যে চুম্বকিত করা হয় তখন পদার্থের অণুচুম্বকগুলি প্রযুক্ত চৌম্বকক্ষেত্রের অভিমুখে পরষ্পর সমান্তরালে সজ্জিত হয়ে যায়। এবং চৌম্বক পদার্থটির মধ্যে চুম্বক ধর্ম প্রকাশিত হয়।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী চৌম্বক পদার্থের ধারণা:
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি চৌম্বক পদার্থের প্রতিটি অনুই এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বক। কিন্তু অচুম্বকিত অবস্থায় চৌম্বক পদার্থের অণু চুম্বকগুলি বা ওয়েবার উপাদানগুলি পাশাপাশি থেকে বদ্ধমুখ-শৃঙ্খল গঠন করে থাকে। ফলে এক মেরুর ক্রিয়া পাশের বিপরীত মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। এইজন্য চৌম্বক পদার্থের মধ্যে সাধারণ অবস্থায় কোনো চৌম্বক ধর্ম প্রকাশ পায় না।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী চুম্বকন প্রক্রিয়ায় চুম্বকে পরিণত করার ধারণা:
ইংরেজ বিজ্ঞানী এউইং এর তত্ত্ব অনুসারে, কোনো চৌম্বক পদার্থের মধ্যে অণুচুম্বকগুলি বদ্ধমুখ শৃঙ্খলে সাজানো থাকে। এখন ঘর্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বা বৈদ্যুতিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করার সময়, প্রত্যেকটি অণুচুম্বকের উত্তর মেরুগুলি একদিকে এবং দক্ষিণ মেরুগুলি বিপরীতদিকে ঘোরানো হয়। এই অবস্থায় চুম্বকের ভেতরের প্রতিটি অণু চুম্বকের উত্তরমেরু ঠিক পাশের অণুচুম্বকের দক্ষিন মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু একেবারে দুইপ্রান্তের মুক্ত মেরুগুলির সামনে কোনো বিপরীত মেরু না থাকায় ওই মেরুগুলি সক্রিয় থাকে। এই অবস্থায় চুম্বকটির যে প্রান্তে অণুচুম্বকের উত্তরমেরুগুলি থাকে, সেই প্রান্তে চুম্বকের উত্তর মেরু এবং যে প্রান্তে অণু চুম্বকের দক্ষিন মেরুগুলি থাকে, সেই প্রান্তে চুম্বকের দক্ষিনমেরুর সৃষ্টি হয়। এবং চৌম্বক পদার্থটি চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী উদাসীন অঞ্চলের ধারণা:
এখন ঘর্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বা বৈদ্যুতিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করার সময়, প্রত্যেকটি অণুচুম্বকের উত্তর মেরুগুলি একদিকে এবং দক্ষিণ মেরুগুলি বিপরীতদিকে ঘোরানো হয়। এই অবস্থায় চুম্বকের ভেতরের প্রতিটি অণু চুম্বকের উত্তরমেরু ঠিক পাশের অণুচুম্বকের দক্ষিন মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু একেবারে দুইপ্রান্তের মুক্ত মেরুগুলির সামনে কোনো বিপরীত মেরু না থাকায় শুধুমাত্র ওই মেরুগুলি সক্রিয় থাকে। তাই কোনো চুম্বকের প্রান্ত থেকে যত মাঝের দিকে যাওয়া যায়, আকর্ষণ ক্ষমতা ততই কমতে থাকে। চুম্বকের একেবারে মাঝখানে আকর্ষণ ক্ষমতা প্রায় থাকেই না বল্লেই চলে। কোনো চুম্বকের মধ্যবর্তী স্থানের এই অঞ্চলকে উদাসীন অঞ্চল বলে।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো চুম্বকের মেরু একেবারে প্রান্তে অবস্থান করে না:
আমরা জানি কোনো চুম্বকের দুইপ্রান্তে আকর্ষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এবং প্রান্ত থেকে যত মাঝের দিকে যাওয়া যায় আকর্ষণ ক্ষমতা ততই কমতে থাকে। চুম্বকের একেবারে মাঝখানে আকর্ষণ ক্ষমতা প্রায় থাকেই না। এর কারণ দন্ড চুম্বকের মধ্যে মধ্যে অণু চুম্বকের সারিগুলির দুইপ্রান্তের মুক্ত সমমেরুগুলি নিজেদের মধ্যে বিকর্ষণের ফলে পরষ্পর থেকে যতটা সমভব দূরে সরে যায়। ফলে চুম্বকের মধ্যে অণুচুম্বকের সারিগুলি সরলরেখায় না থেকে বক্ররেখায় সজ্জিত হয়। এই ধরণের বিন্যাসের ফলে মুক্ত মেরুগুলি কেবল চুম্বকের দুপ্রান্তে না থেকে ধারেও একটু ছড়িয়ে থাকে। এইজন্যে চুম্বকের ধারেও আকর্ষণ ক্ষমতা জন্মায়। এই কারণে দন্ডচুম্বকের মেরু, দন্ডের একেবারে প্রান্তে অবস্থিত না হয়ে প্রান্তের কাছাকাছি কোনো বিন্দুতে অবস্থিত হয়।
ভূ-চুম্বকত্ব (Terrestrial Magnetism):
আমরা জানি, মুক্ত অবস্থায় ঝোলানো কোনো চুম্বক বা চুম্বক শলাকা সর্বদা উত্তর দক্ষিন মুখ করে থাকে। শলাকাটিকে আবার নাড়িয়ে দিলে কিছুক্ষন আন্দোলনের পর পূনরায় পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় সর্বত্রই এরকম আচরণ লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় যেন কোনো আকর্ষণ বলের জন্য চুম্বক শলাকা ওইরূপ নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে থাকে।
এই ঘটনা লক্ষ্য করে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথের চিকিৎসক ডাঃ গিলবার্ট মত প্রকাশ করেন যে, পৃথিবী নিজেই একটি বিরাট চুম্বক। কারণ হিসাবে তিনি বলেন চুম্বক শলাকাকে প্রভাবিত করতে পারে একমাত্র চুম্বকই। যেহেতু চতুর্দিকে অন্য কোথাও চুম্বক নেই, তাই পৃথিবীর নিজ চৌম্বকক্ষেত্রের জন্যেই শলাকাটি এরূপ আচরণ করে। অবশ্য পরে তিনি চুম্বক দিয়ে গোলক তৈরি করে তার নিকট ছোটো ছোটো চুম্বক শলাকা বিভিন্ন জায়গায় রেখে পরীক্ষা করে দেখান যে, পৃথিবীর সাথে এর যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।
একটি দন্ডচুম্বকের মাঝখানে পাকহীন সুতো দিয়ে বেঁধে বাধাহীন অবস্থায় ঝুলিয়ে দিলে চুম্বকটি সর্বদা উত্তর দক্ষিনে মুখ করে স্থির থাকে। চুম্বকটিকে পুনরায় নাড়িয়ে ছেড়ে দিলে এটি কয়েকবার এদিক ওদিক ঘুরে আবার আগের মতোই উত্তর-দক্ষিন মুখ করে দাঁড়ায়। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, নিশ্চয়ই কোনো বাহ্যিক আকর্ষণ বলের প্রভাবে মুক্ত অবস্থায় ঝোলানো চুম্বকটি সর্বদা উত্তর দক্ষিন দিকে মুখ করে থাকে।
এই ঘটনা দেখে 1660 সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী গিলবার্ট সর্বপ্রথম সিদ্ধান্ত করেন যে, পৃথিবী নিজেই একটি বিরাট চুম্বক এবং সাধারণ চুম্বকের মতো পৃথিবীরও দুটি মেরু আছে। একেই ভূ-চুম্বক বলে।
পৃথিবী নিজেই একটি বিরাট চুম্বক তার স্বপক্ষে যুক্তি:
(1) পৃথিবীর মেরু অঞ্চল ছাড়া যেকোনো স্থানে একটি দন্ডচুম্বককে তার ভারকেন্দ্র থেকে বাধাহীনভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হলে তা সর্বদাই উত্তর দক্ষিন মুখ করে থাকে। চুম্বকটিকে সাম্যাবস্থান থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটিয়ে ছেড়ে দিলেও কিছুক্ষণ আন্দোলিত হওয়ার পর তা আবার আগের অবস্থানেই ফিরে আসে। মেরু অঞ্চলে চুম্বকটি সর্বদাই উল্লম্বভাবে থাকে। সুতরাং পরীক্ষাধীন চুম্বকটি নিশ্চই কোনো চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত।
(2) ভূ-পৃষ্ঠের কোনো স্থানে চৌম্বক পদার্থ (লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট) জাতীয় অয়ঃশ্চৌম্বক পদার্থের দন্ডকে দীর্ঘদিন উল্লম্বভাবে বা উত্তর দক্ষিন বরাবর পুঁতে রাখলে তার মধ্যে ক্ষীণ চুম্বকত্বের সৃষ্টি হয়।
(3) ভূ-পৃষ্ঠের কাছ দিয়ে কোনো উড়োজাহাজ অনুভূমিকভাবে উড়ে গেলে তার ডানার দুই প্রান্তবিন্দুর মধ্যে একটি বিভবপ্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং এক্ষেত্রে উড়োজাহাজটি নিশ্চয়ই কোনো চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে গতিশীল।
এই কারণগুলির জন্যে পৃথিবীকে একটি বিরাট চুম্বক বলে মনে করা হয়।
সাধারণ চুম্বকের মতোই ভূ-চুম্বকেরও দুটি মেরু আছে। কিন্তু ভূ-চুম্বকের মেরু এবং ভৌগলিক মেরু এক জায়গায় অবস্থিত নয়।
ভূ-চুম্বকের উত্তরমেরুটি, ভৌগলিক উত্তরমেরু থেকে প্রায় 2414 কিলোমিটার পশ্চিমে কানাডার বোথিয়া ফেলিক্স অঞ্চলে অবস্থিত। এই ভূচুম্বকের উত্তর মেরুকে নীল মেরু বলে। এবং
ভূ-চুম্বকের দক্ষিনমেরুটি, ভৌগলিক দক্ষিনমেরু থেকে প্রায় 2250 কিলোমিটার পূর্বে দক্ষিন ভিক্টোরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। এই ভূচুম্বকের দক্ষিন মেরুকে লাল মেরু বলে।
এই ভূ-চুম্বকের উত্তরমেরু এবং ভূ-চুম্বকের দক্ষিন মেরুর সংযোগকারী সরলরেখাকে পৃথিবীর চৌম্বক অক্ষ বলে। পৃথিবীর চৌম্বক অক্ষটি, পৃথিবীর ভৌগলিক অক্ষের সঙ্গে প্রায় 18 ডিগ্রী কোণ করে থাকে।
ভৌগলিক অক্ষ:
ভৌগলিক উত্তর ও দক্ষিন মেরুকে যুক্ত করে একটি সরলরেখা কল্পনা করলে তাকে ভৌগলিক অক্ষ বলে।
ভৌগলিক বিষুবরেখা:
ভৌগলিক অক্ষের কেন্দ্র দিয়ে অক্ষের অভিলম্ব রেখাকে ভৌগলিক বিষুবরেখা বলে।
চৌম্বক অক্ষ:
পৃথিবীর চৌম্বক উত্তরমেরু ও দক্ষিনমেরুকে যুক্ত করে একটি সরলরেখা কল্পনা করলে তাকে চৌম্বক অক্ষ বলে।
চৌম্বক বিষুবরেখা:
চৌম্বক অক্ষের কেন্দ্র দিয়ে অক্ষের অভিলম্ব রেখাকে চৌম্বক বিষুবরেখা বলে।
কয়েকটি অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন:
ওয়েবারের উপাদান কি?
কোনো একটি চুম্বককে বারবার বিভাজন করলে, যে ক্ষুদ্রতম বিভাজিত অংশ পাওয়া যায়, সেটিও একটি ক্ষুদ্র চুম্বক। এইরূপ চুম্বককে অণুচুম্বক বলে। বিজ্ঞানী ওয়েবারের নাম অনুসারে এই অণুচুম্বকগুলিকে ওয়েবারের উপাদান বলা হয়।
ইউইং শৃঙ্খল কাকে বলে?
চৌম্বক পদার্থের মধ্যে ওয়েবারের উপাদানগুলি এলোমেলো ভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থায় সাজানো থাকায়, একটি অণুচুম্বকের কোনো একটি মেরু অপর অণুচুম্বকের বিপরীত মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। এর ফলে কোনো মুক্ত মেরু থাকে না। এইরূপ বদ্ধমুখ শৃঙ্খলকে ইউইং শৃঙ্খল বলে।
ভূ-চৌম্বক মূলরাশি কাকে বলে?
পৃথিবীর কোনও একটি স্থানের ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য যেসব ভৌতরাশিগুলি ব্যবহার করা হয়, সেই রাশিগুলিকে ভূ-চুম্বকের মূলরাশি বলে। যেমন, বিনতি কোণ, বিচ্যুতি কোণ এবং ভূ-চুম্বকক্ষেত্রের অণুভূমিক উপাংশ।
কোনো একটি চুম্বকের দুটি মেরুর মধ্যে মূল সাদৃশ্য কি?
কোনও একটি নির্দিষ্ট চুম্বকের দুটি মেরুর শক্তি সর্বদা সমান হয়।
চুম্বকের মেরুশক্তির একক কি?
চুম্বকের মেরুশক্তির একক হল: অ্যাম্পিয়ার-মিটার (A-m)
তড়িতের প্রভাবে কোনও চুম্বকের চুম্বকত্বের কি পরিবর্তন হতে পারে?
কোনো চুম্বকের গায়ে অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে তার মধ্য দিয়ে পরিবর্তী তড়িৎপ্রবাহ (A.C Current) চালনা করা হলে, ওই চুম্বকটির চুম্বকত্ব হ্রাস পায় বা নষ্টও হয়ে যেতে পারে।
কোন্ ব্যবস্থা অবলম্বন করে সমুদ্রের ঢেউয়ের জন্য জাহাজের আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও নৌকম্পাসের কাঁটাকে অনুভূমিক রাখা হয়?
গিমবল ব্যবস্থা অবলম্বন করে সমুদ্রের ঢেউয়ের ফলে জাহাজের আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও নৌকম্পাসের কাঁটাকে অনুভূমিক রাখা হয়।
হিউস্লার সংকর (Hausler alloy) ধাতু কি?
হিউস্লার সংকর ধাতু হল তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের তৈরী একপ্রকার সংকর ধাতু। এই সংকর ধাতুটি একটি চৌম্বক পদার্থ। অর্থাৎ লোহা, নিকেল, কোবাল্টের মতো এই হিউস্লার সংকর ধাতুটিও চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয়। এই হিউস্লার সংকর ধাতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে - এর উপাদান মৌল ধাতুগুলি অচৌম্বক পদার্থ হলেও, এদের মিশ্রণে উৎপাদিত সংকর ধাতুটি একটি চৌম্বক পদার্থ।
হ্যাডফিল্ড ম্যাঙ্গানিজ স্টীল কি?
লোহা ও ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রণে উৎপাদিত সংকর ধাতু হ্যাডফিল্ড ম্যাঙ্গানিজ স্টিল একটি অচৌম্বক পদার্থ। এই সংকর ধাতুটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল - এর একটি উপাদান মৌল লোহা চৌম্বক পদার্থ হলেও, লোহা ও ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রনে উৎপাদিত সংকর ধাতু হ্যাডফিল্ড ম্যাঙ্গানিজ স্টিল একটি অচৌম্বক পদার্থ।
লাল মেরু ও নীল মেরু কাকে বলা হয়?
পৃথিবীর চৌম্বক দক্ষিন মেরুকে লাল মেরু বলে। এটি পৃথিবীর ভৌগলিক দক্ষিন মেরু থেকে 2250 কিমি পূর্বে দক্ষিন ভিক্টোরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। আবার পৃথিবীর চৌম্বক উত্তর মেরুকে নীল মেরু বলে। এটি পৃথিবীর ভৌগলিক উত্তর মেরু থেকে প্রায় 2414 কিমি পশ্চিমে কানাডার বোথিয়াফেলিক্স অঞ্চলে অবস্থিত।
যে সমস্ত বস্তু লোহা, নিকেল ও কোবাল্ট ইত্যাদি চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং যার দিগ্দর্শী ধর্ম আছে, তাকে চুম্বক বলে।
চৌম্বক পদার্থ:
যে সমস্ত পদার্থ চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং যাদেরকে কৃত্রিম উপায়ে চুম্বকে পরিণত করা যায়, তাদের চৌম্বক পদার্থ বলে। যেমন, কাঁচা লোহা, ইষ্পাত, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদি হল চৌম্বক পদার্থ।
চুম্বকত্ব:
যে ধর্মের জন্য কোনো চুম্বক, চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে এবং দিক নির্দেশ করতে পারে, সেই ধর্মকে চুম্বকের চুম্বকত্ব বলে। এই চুম্বকত্ব পদার্থের একটি ভৌত ধর্ম। কারণ এই ধর্মের জন্য পদার্থের অণুর গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না।
চুম্বকের প্রকারভেদ: উৎসের বিচারে চুম্বককে দুইভাগে ভাগ করা যায়:
(i) প্রাকৃতিক চুম্বক
(ii) কৃত্রিম চুম্বক
প্রাকৃতিক চুম্বক (Natural Magnet):
প্রকৃতিতে লোহা ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরি ম্যাগনেটাইট পাথর পাওয়া যায়, যার মধ্যে চুম্বকত্ব ধর্ম দেখা যায়, অর্থাৎ লোহা, নিকেল, কোবাল্ট ইত্যাদিকে আকর্ষণ করতে পারে এবং দিগ্দর্শী ধর্মও আছে, তাকে প্রাকৃতিক চুম্বক বা লোডস্টোন বলে। এর রাসায়নিক সংকেত \(F{e_3}{O_4}\)।
এই প্রাকৃতিক চুম্বকের নির্দিষ্ট কোনো আকার থাকে না। তাছাড়া এর আকর্ষণী ক্ষমতাও অনেক কম হয়।
কৃত্রিম চুম্বক (Artificial Magnet):
লোহা, ইষ্পাত , কোবাল্ট , নিকেল বা এদের বিভিন্ন সংকর ধাতুকে কয়েকটি বিশেষ পদ্ধতিতে চুম্বকে পরিণত করা হলে, ওই চুম্বককে কৃত্রিম চুম্বক বলে।
প্রাকৃতিক চুম্বকের নির্দিষ্ট কোনো জ্যামিতিক আকার বা আকৃতি নেই এবং প্রাকৃতিক চুম্বকের চৌম্বক শক্তিও অনেক কম ও দিগ্দর্শী ধর্মও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিশেষ আকার বিশিষ্ট শক্তিশালী চুম্বকের প্রয়োজন হয়। এইজন্য কৃত্রিম উপায়ে নানান আকারের চুম্বক প্রস্তুত করা হয়। এগুলিই কৃত্রিম চুম্বক।
আবার কোনও চুম্বকের চুম্বকত্ব স্থায়িত্বের উপর নির্ভর করে চুম্বককে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
(1) স্থায়ী চুম্বক (Parmanent Magnet):
যে সমস্ত কৃত্রিম চুম্বকের চুম্বকত্ব অনেকদিন বজায় থাকে, সহজে নষ্ট হয় না, তাদের স্থায়ী চুম্বক বলে। যেমন: দন্ড চুম্বক, অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক, চুম্বক শলাকা ইত্যাদি হল স্থায়ী চুম্বক।
(2) অস্থায়ী চুম্বক (Temporary Magnet):
যে সমস্ত কৃত্রিম চুম্বকের চুম্বকত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয় না, তাদের অস্থায়ী চুম্বক বলে।
যেমন, কাঁচা লোহার দন্ডকে ঘর্ষণ প্রণালীতে চুম্বকে পরিণত করা হলে যদিও বেশ শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয়, কিন্তু ওই চুম্বকের চুম্বকত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
বিভিন্ন ধরণের চুম্বক:
ব্যবহারের সুবিধার জন্যবিভিন্ন আকারের কৃত্রিম চুম্বক তৈরি করা হয়।
(1) দন্ডচুম্বক (Bar Magnet):
আয়তঘনক আকারের কোনো ইষ্পাতদন্ডকে চুম্বকে পরিণত করা হলে, তাকে দন্ডচুম্বক বলে।
পরীক্ষাগারে বিভিন্ন কাজে এই ধরণের চুম্বক ব্যবহার করা হয়।
(2) চুম্বকশলাকা (Magnetic Needle):
এটি চুম্বকিত ইষ্পাতের তৈরি একটি পাতলা পাত যার দুইপ্রান্ত ছুঁচালো থাকে। পাতটির মধ্যবিন্দু একটি সোজা দন্ডের ছুঁচালো মুখের ওপর এমনভাবে বসানো থাকে যাতে শলাকাটি অনুভূমিক তলে অবাধে ঘুরতে পারে। একে চুম্বকশলাকা বলে।
(3) অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক (U-Shaped Magnet):
ইংরেজী U অক্ষরের মতো বাঁকানো ইষ্পাতদন্ডকে চুম্বকে পরিণত করলে সেই চুম্বককে অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক বলে। এই চুম্বকের দুটি মেরু খুব কাছাকাছি থাকে।
(4) গোলক-মুখযুক্ত চুম্বক (Dumbel-Shaped Magnet):
যে দন্ডচুম্বকের দুইপ্রান্তে দুটি গোলক যুক্ত থাকে, তাকে গোলক-মুখযুক্ত চুম্বক বলে। এটি দেখতে ডাম্বেলের মতো হয়।
(5) তড়িৎচুম্বক (Electromagnet):
কাঁচালোহার তৈরি একটি দন্ডের ওপর অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে, ওই তারদুটির দুইপ্রান্তে সমপ্রবাহ তড়িৎ চালনা করলে, ওই দন্ডটি একটি শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয়। যতক্ষণ তড়িৎপ্রবাহ বজায় থাকে ততক্ষণ দন্ডটির চুম্বকত্ব স্থায়ী হয়। তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করলেই এর চুম্বকত্ব আর থাকে না।
(6) মেরুবিহীন চুম্বক:
কাঁচালোহার তৈরি একটি আংটা বা বৃত্তাকার বলয়ের গায়ে অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে ওই তারের মধ্যে সমপ্রবাহ তড়িৎ চালনা করলে বলয়টি একটি চুম্বকে পরিণত হয়। এই চুম্বকের কোনও মেরু থাকে না। একে মেরুবিহীন চুম্বক বলে।
এখন এই চুম্বকের যে কোনও স্থান কেটে ফেললে, ওই স্থানের দুই বিপরীত প্রান্তে দুটি মেরুর সৃষ্টি হয়।
প্রাকৃতিক চুম্বক ও কৃত্রিম চুম্বকের মধ্যে পার্থক্য:
প্রাকৃতিক চুম্বক | কৃত্রিম চুম্বক |
(1) প্রাকৃতিক চুম্বকের নির্দিষ্ট কোনও আকার থাকে না। | (1) কৃত্রিম চুম্বকের নির্দিষ্ট আকার থাকে। |
(2) প্রাকৃতিক চুম্বকের শক্তি কম হয় এবং এই চুম্বকের মেরুশক্তি পরিবর্তন করা যায় না। | (2) কৃত্রিম চুম্বক শক্তিশালী হয় এবং এই চুম্বকের মেরুশক্তি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বাড়ানো বা কমানো যায়। |
(3) প্রাকৃতিক চুম্বকের চুম্বকত্ব স্থায়ী। | (3) কৃত্রিম চুম্বকের চুম্বকত্ব প্রয়োজন মতো স্থায়ী বা অস্থায়ী করা যায়। |
(4) প্রাকৃতিক চুম্বক সাধারণত ব্যবহারিক কাজে লাগে না। | (4) কৃত্রিম চুম্বককে বিভিন্ন যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়। |
চুম্বকের ধর্ম (Property of Magnet):
প্রত্যের চুম্বকেরই দুটি বিশেষ ধর্ম আছে।
(1) আকর্ষণী ধর্ম (Attractive Property):
(2) দিগ্দর্শী ধর্ম (Directive Property):
আকর্ষণী ধর্ম:
যে ধর্মের জন্য চুম্বক লোহা, নিকেল, কোবাল্ট বা এদের সংকর ধাতুকে আকর্ষণ করতে পারে, তাকে চুম্বকের আকর্ষণী ধর্ম বলে। কিন্তু এই আকর্ষণী ধর্ম চুম্বকের দৈর্ঘ্য বরাবর সব জায়গায় সমান হয় না।
দিগ্দর্শী ধর্ম:
কোনো দন্ডচুম্বককে বাধাহীনভাবে ঝুলিয়ে দিলে এটি উত্তর-দক্ষিন বরাবর মুখ করে থাকে। দন্ডচুম্বকের এই ধর্মকে দিগ্দর্শী ধর্ম বলে।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা:
(1) চুম্বক মেরু (Magnetic Pole):
কোনো চুম্বকের দুইপ্রান্তের কাছাকাছি যে দুই বিন্দুতে চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, সেই বিন্দু দুটিকে চুম্বকের মেরু বা চুম্বক-মেরু বলে।
একটি দন্ডচুম্বককে একটি পাকহীন সুতোর সাহায্যে মুক্ত অবস্থায় অনুভূমিকভাবে ঝুলিয়ে দিলে চুম্বকের যে মেরুটি মোটামুটি উত্তরদিকে মুখ করে থাকে, তাকে উত্তর সন্ধানী মের বা উত্তর মেরু (N) এবং যে মেরুটি দক্ষিন দিকে মুখ করে থাকে, তাকে দক্ষিন সন্ধানী মেরু বা দক্ষিন মেরু (S) বলে। চুম্বকের উত্তরমেরুকে N এবং দক্ষিন মেরুকে S অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
চুম্বকের মেরুদুটি, চুম্বকের একবারে প্রান্ত থাকে না। চুম্বকের মধ্যে প্রান্তের কাছাকাছি কোনো বিন্দুতে থাকে। চুম্বক মেরুর আকর্ষণ ক্ষমতার পরিমাপকে ওই চুম্বকের মেরুশক্তি বলে। যেকোনো চুম্বকের উভয় মেরুর মেরুশক্তি সবসময় সমান হয়।
চৌম্বক অক্ষ (Magnetic axis):
কোনো চুম্বকের মেরু দুটির সংযোজক সরলরেখাকে চৌম্বক অক্ষ বলে।
চৌম্বকদৈর্ঘ্য (Magnetic Length):
কোনো চুম্বকের দুই মেরুর মাঝের দূরত্বকে চৌম্বক দৈর্ঘ্য বলে। এই চৌম্বক দৈর্ঘ্য, চুম্বকের প্রকৃত জ্যামিতিক দৈর্ঘ্যের চেয়ে কিছুটা কম হয়।
কোনো চুম্বকের প্রকৃত দৈর্ঘ্য L হলে, ওর চৌম্বক দৈর্ঘ্য হয় NS = 0.86L
চৌম্বক মধ্যতল (Magnetic Meridian):
কোনো স্থানে বাধাহীনভাবে ঝোলানো একটি চুম্বকের স্থির অবস্থানে, ওই চুম্বকের চৌম্বক অক্ষ বরাবর যে উল্লম্ব তল কল্পনা করা যায়, তাকে ওই স্থানের চৌম্বক মধ্যতল বলে।
উদাসীন অঞ্চল (Neutral Region):
কোনো দন্ডচুম্বকের ঠিক মাঝখানে, চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতা প্রায় থাকেই না। চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতাহীন এই অঞ্চলকে উদাসীন অঞ্চল বলে।
নিরপেক্ষ রেখা (Neutral Line):
চৌম্বক অক্ষের মধ্যবিন্দু দিয়ে চৌম্বক অক্ষের ওপর লম্ব টানলে ওই লম্বরেখার যে অংশ চুম্বকের মধ্যে থাকে, তাকে নিরপেক্ষ রেখা বলে।
চৌম্বকক্ষেত্র (Magnetic Field):
একটি চুম্বককে কোনো একটি স্থানে রাখলে, ওই চুম্বকের চারপাশের যে স্থান জুড়ে চুম্বকের আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল কাজ করে, তাকে ওই চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র বলে।
কোনো চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তৃতি, ওই চুম্বকের মেরুশক্তির ওপর নির্ভর করে। গাণিতিক হিসাবে একটি চুম্বকের চৌম্বকক্ষেত্র অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু বাস্তবে চৌম্বকক্ষেত্র চুম্বকটির চারিদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
চুম্বকের দুটি বিশেষ ধর্ম:
(1) চুম্বকের সমমেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষণ করে:
পরীক্ষা:
একটি চুম্বক শলাকা এবং উত্তর (N) ও দক্ষিন (S) মেরু চিহ্নিত একটি দন্ডচুম্বক নেওয়া হল। একটিদন্ডচুম্বকের উত্তরমেরুকে, চুম্বকশলাকার উত্তরমেরুর কাছে আনা হল। দেখা যাবে যে, চুম্বক শলাকার উত্তর মেরুটি দূরে সরে গেলো।
এবার দন্ডচুম্বকের দক্ষিন মেরুকে, চুম্বক শলাকার দক্ষিন মেরুর কাছে আনা হল। দেখা যাবে যে, চুম্বক শলাকার দক্ষিন মেরুটি দূরে সরে গেলো।
অর্থাৎ বলা যায় চুম্বকের সমমেরু দুটি পরস্পর পরস্পরকে বিকর্ষণ করে।
এবার দন্ডচুম্বকটির দক্ষিন (S) মেরুকে, চুম্বকশলাকার উত্তরমেরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। দেখা যাবে যে, চুম্বক শলাকার উত্তরমেরু, দন্ডচুম্বকের দক্ষিন মেরুর কাছে সরে এলো। অনুরূপভাবে, দন্ডচুম্বকের উত্তরমেরুকে (N), চুম্বকশলাকার দক্ষিনমেরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হল। দেখা যাবে যে, চুম্বকশলাকার দক্ষিন মেরু, দন্ডচুম্বকের উত্তরমেরুর কাছে সরে এলো।
অর্থাৎ, চুম্বকের বিপরীত মেরু দুটি পরস্পরকে আকর্ষণ করে।
সিদ্ধান্ত:
এর থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, চুম্বকের সমমেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে এবং চুম্বকের বিপরীত মেরু পরষ্পরকে আকর্ষণ করে।
(2) আকর্ষণের চেয়ে বিকর্ষণই চুম্বকত্বের প্রকৃষ্ট প্রমান:
(i) দুটি চুম্বকের সমমেরু পরষ্পরকে বিকর্ষণ করে এবং বিপরীত মেরু পরষ্পরকে আকর্ষণ করে। আবার কোনো চুম্বকের উভয়মেরুই চৌম্বক পদার্থকে আকর্ষণ করে, বিকর্ষণ করে না।
সুতরাং, যদি কোনোও চুম্বকের একটি মেরু পরীক্ষাধীন কোনও বস্তুকে আকর্ষণ করে, তবে দুইরকম সিদ্ধান্ত করা যায়। যেমন:
(a) বস্তুটির যে প্রান্ত আকৃষ্ট হচ্ছে, সেই প্রান্তটিতে আকর্ষণকারী মেরুর বিপরীত মেরু বর্তমান। অর্থাৎ পরীক্ষাধীন বস্তুটি চুম্বক আবার,
(b) পরীক্ষাধীন বস্তুটি চৌম্বক পদার্থ (লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট)।
সুতরাং কোনও চুম্বক ও পরীক্ষাধীন বস্তুর মধ্যে কেবলমাত্র আকর্ষণ দেখে বস্তুটি চুম্বক কিনা তা বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু, কোনও চুম্বকের একটি মেরু যদি পরীক্ষাধীন কোনো বস্তুকে বিকর্ষণ করে তবে নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, পরীক্ষাধীন বস্তুর বিকর্ষিত প্রান্তে চুম্বকটির সমমেরু বর্তমান। অর্থাৎ পরীক্ষাধীন বস্তুটি একটি চুম্বক, চৌম্বক পদার্থ নয়। সুতরাং বিকর্ষণই চুম্বকত্বের প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
চুম্বকন পদ্ধতি (Method of Magtetisation):
চৌম্বক পদার্থকে কৃত্রিম উপায়ে চুম্বকে পরিণত করার পদ্ধতিতে চুম্বকন পদ্ধতি বলে।
কোনো চৌম্বক পদার্থকে প্রধাণত দুটি উপায়ে কৃত্রিম চুম্বকে পরিণত করা হয়। যথা:
(1) ঘর্ষণ প্রণালী:
(2) বৈদ্যুতিক প্রণালী:
ঘর্ষণ পদ্ধতিতে তিনরকম উপায়ে কোনো চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করা যায়। যথা:
(1) একক-স্পর্শ প্রণালী
(2) পৃথক-স্পর্শ প্রণালী
(3) যুগ্ম-স্পর্শ প্রণালী
এখানে মূলত বৈদ্যুতিক প্রণালীতে কিভাবে একটি চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করা যায় তার আলোচনা করা হল।
বৈদ্যুতিক প্রণালী:
এই পদ্ধতিতে কাঁচা লোহার দন্ডের ওপর অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে ওই তারের মধ্য দিয়ে সমপ্রবাহ তড়িত (DC) পাঠালে, ওই লোহার দন্ডটি একটি চুম্বকে পরিণত হয়। এবং তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করলে চুম্বকটির চৌম্বকত্ব লোপ পায়। এই ধরনের চুম্বককে তড়িৎচুম্বক বলে।
তড়িৎচুম্বক (Electromagnet):
একটি কাঁচালোহার দন্ডের ওপর অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে, ওই তারের মধ্য দিয়ে সমপ্রবাহ তড়িৎ (DC) চালনা করলে, ওই লোহার দন্ডটি একটি চুম্বকে পরিণত হয়। এবং তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করলেই চুম্বকটির চৌম্বকত্ব লোপ পায়। এই ধরণের চুম্বককে তড়িৎচুম্বক বলে।
অশ্বখুরাকৃতি তড়িৎচুম্বক (U-Shaped Magnet):
অশ্বখুরাকৃতি তড়িৎচুম্বক তৈরি করতে গেলে প্রথমে একটি "U" আকারের কাঁচা লোহার দন্ড নেওয়া হয়। ওই লোহার দন্ডের দুই বাহুর ওপর অন্তরিত তামার তার বিপরীত পাকে জড়ানো হয়। এবার ওই অন্তরিত তামার তারের দুইপ্রান্তে সমপ্রবাহ তড়িৎ (DC) চালনা করা হলে "U" আকারের দন্ডটি একটি শক্তিশালী তড়িৎচুম্বকে পরিণত হয়। একে অশ্বখুরাকৃতি চুম্বক বলে। এই অশ্বখুরাকৃতি চুম্বকে মেরুদুটি খুব কাছাকাছি থাকায়, এই চুম্বক খুব শক্তিশালী হয়।
তড়িৎচুম্বকের কোন্ প্রান্তে কোন্ মেরু সৃষ্টি হবে তার প্রকৃতি নির্ণয়:
কোনো তড়িৎচুম্বকের দন্ডের যেকোনও একটি প্রান্তের দিকে তাকালে, ওই প্রান্তে তারের পাক যদি ঘড়ির কাঁটার দিকে হয় অর্থাৎ দক্ষিণাবর্তী হয়, তাহলে ওই প্রান্তে দক্ষিণমেরুর (S) সৃষ্টি হবে। আবার তড়িৎচুম্বকের দন্ডের যে প্রান্তে তারের পাক ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী হয় অর্থাৎ বামাবর্তী হয় তাহলে ওই প্রান্তে উত্তরমেরুর (N) মেরুর সৃষ্টি হবে।
একটি তড়িৎচুম্বকের শক্তি কোন্ কোন্ উপায়ে বাড়ানো যায়?
(1) একটি তড়িৎচুম্বকে অন্তরিত তামার তারের পাকসংখ্যা বাড়িয়ে তড়িৎচুম্বকের শক্তি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়।
(2) একটি তড়িৎচুম্বকের মধ্য দিয়ে সমপ্রবাহমাত্রার মান বাড়িয়ে তড়িৎচুম্বকের শক্তি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যায়।
(3) তড়িৎচুম্বকে ইষ্পাতের পরিবর্তে কাঁচালোহা ব্যবহার করলে তড়িৎচুম্বকের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
তড়িৎচুম্বকের ব্যবহার:
(1) কলকারখানা অথবা বন্দরে লোহার ভারী বস্তুকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাতে তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করা হয়।
(2) ইলেকট্রিক কলিং বেল, টেলিগ্রাফ, বৈদ্যুতিক মোটর ও ডায়নামো, বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক ট্রেন ইত্যাদি যন্ত্রে তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করা হয়।
(3) চোখে লোহার কুচি বা গুঁড়ো পড়লে তা বের করতে ডাক্তাররা সূক্ষাগ্র মেরুযুক্ত তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করেন।
(4) টেলিফোন, মাইক্রোফোন, লাউডস্পীকার ইত্যাদি যন্ত্রে তড়িৎচুম্বক ব্যবহার করা হয়।
সাধারণ চুম্বক ও তড়িৎচুম্বকের মধ্যে পার্থক্য:
সাধারণ চুম্বক | তড়িৎচুম্বক |
(1) সাধারণ চুম্বকের চুম্বকত্ব স্থায়ী। | (1) তড়িৎচুম্বকের চুম্বকত্ব অস্থায়ী। |
(2) সাধারণ চুম্বকের মেরুশক্তি নির্দিষ্ট। একে বাড়ানো বা কমানো যায় না। | (2) তড়িৎচুম্বকের মেরুশক্তি প্রয়োজন মতো বাড়ানো বা কমানো যায়। |
(3) সাধারণ চুম্বকের মেরুদুটির অবস্থান নির্দিষ্ট। | (3) তড়িৎচুম্বকে, তড়িৎপ্রবাহের অভিমুখ পরিবর্তন করে মেরুদুটির অবস্থান পরিবর্তন করা যায়। |
(4) সাধারণ চুম্বক কম শক্তিশালী। | (4) তড়িৎচুম্বক অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী। |
(5) সাধারণ চুম্বকের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। | (5) তড়িৎচুম্বকের ব্যবহার খুবই ব্যাপক। |
চৌম্বক আবেশ (Magnetic Induction):
একটি শক্তিশালী চুম্বককে কোনো চৌম্বক পদার্থের (লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট) কাছে আনলে বা স্পর্শ করালে চৌম্বক পদার্থটি সাময়িকভাবে চুম্বকে পরিণত হয়। এখন যদি চুম্বকটিকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়, তবে চৌম্বক পদার্থটি তার চুম্বকত্ব হারায়। এই ঘটনাকে চৌম্বক আবেশ বলে।
সংজ্ঞা (Definition):
কোনো চৌম্বক পদার্থকে একটি শক্তিশালী চুম্বক মেরুর কাছে আনলে বা তার চুম্বক মেরুতে স্পর্শ করালে চৌম্বক পদার্থটি সাময়িকভাবে চুম্বককত্ব লাভ করে। এখন চুম্বকটিকে সরিয়ে নেওয়া হলে, চৌম্বক পদার্থটির চম্বকত্ব হারায়। এই ঘটনাকে চৌম্বক আবেশ বলে।
আবেশকারী চুম্বক:
যে চুম্বকের সাহায্যে চৌম্বক পদার্থটি সাময়িকভাবে চুম্বকে পরিণত হয়, তাকে আবেশকারী চুম্বক বলে।
আবেশকারী মেরু:
আবেশকারী চুম্বকের যে মেরু চৌম্বক পদার্থের কাছে থাকে, তাকে আবেশকারী মেরু বলে।
আবিষ্ট চুম্বক:
আবেশের ফলে যে চৌম্বক পদার্থটি চুম্বকে পরিণত হয়, তাকে আবিষ্ট চুম্বক বলে।
আবিষ্ট মেরু:
চৌম্বক আবেশের ফলে চৌম্বক পদার্থের দুইপ্রান্তে যে দুই মেরুর সৃষ্টি হয়, তাদের আবিষ্ট মেরু বলে।
আবিষ্ট চুম্বকত্ব:
আবেশের ফলে কোনো চৌম্বক পদার্থ সাময়িকভাবে যে চুম্বকত্ব লাভ করে, তাকে আবিষ্ট চুম্বকত্ব বলে। আবেশকারী চুম্বক সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবিষ্ট চুম্বকত্ব লোপ পায়। অর্থাৎ আবিষ্ট চুম্বকত্ব অস্থায়ী।
আবিষ্ট চুম্বকের মেরুর প্রকৃতি:
চৌম্বক আবেশের ফলে আবিষ্ট চুম্বকে, আবেশকারী মেরুর নিকটতম প্রান্তে বিপরীত মেরু এবং দূরতম প্রান্তে সমমেরুর সৃষ্টি হয়।
আকর্ষণের পূর্বে আবেশ হয় - কথাটি ব্যাখ্যা করো:
চুম্বকের একটি মেরুকে কোনো চৌম্বক পদার্থের কাছে আনলে চৌম্বক আবেশের ফলে চৌম্বক পদার্থের নিকটতম প্রান্তে আবেশকারী মেরুর বিপরীত মেরু এবং দূরপ্রান্তে সমমেরুর সৃষ্টি হয়।
ফলে আবেশকারী মেরু এবং আবিষ্ট নিকট মেরুর মধ্যে একটি আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে। অবশ্য একই সঙ্গে আবেশকারী মেরু এবং দূরপ্রান্তের আবিষ্ট সমমেরুর মধ্যেও বিকর্ষণ বলও ক্রিয়া করে। কিন্তু এদের মধ্যে দূরত্ব বেশি হওয়ায় বিকর্ষণ বল, আকর্ষণ বলের চেয়ে কম হয়। ফলে চুম্বকটি ওই চৌম্বক পদার্থকে নিজের দিকেই আকর্ষণ করে।তাই বলা হয় - আকর্ষণের পূর্বে আবেশ হয়।
প্রত্যেক চুম্বকে সর্বদা দুটি মেরু থাকবেই - একক মেরুর অস্থিত্ব সম্ভব নয়:
একটি দন্ডচুম্বকের দুইপ্রান্তে দুটি মেরু বর্তমান থাকে। ওই চুম্বকের মাঝখানে চৌম্বক ধর্ম থাকে না বল্লেই চলে। তাই মনে হতে পারে, একটি দন্ডচুম্বককে ভেঙে দুইটুকরো করলে দুটি অংশে একটি করে মেরু পাওয়া যাবে। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, উভয় খন্ডই দুই মেরু বিশিষ্ট একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বক। এই টুকরো দুটিকে যদি আবার অর্ধেক করা হয়, তখন প্রতিটি টুকরোই আবার দুই মেরু বিশিষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বক হবে। এইভাবে চুম্বককে ভেঙে যত ছোটই করা হোক না কেন তার দুইপ্রান্তে সর্বদা দুটি মেরু পাওয়া যাবে। সুতরাং বলা যায় যে - চুম্বকের দুই মেরু বিপরীতধর্মী হলেও অবিচ্ছেদ্য। অর্থাৎ একক মেরু বিশিষ্ট চুম্বক পাওয়া সম্ভব নয়।
চুম্বকের আণবিক তত্ত্ব:
একটি চুম্বককে ভেঙে যতই ছোটো করা হোক না কেন, তার দুইটি মেরুকে কখনোই পৃথক করা যায় না। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়েবার (Weber) সর্বপ্রথম চুম্বকত্বের আণবিক মতবাদ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, চুম্বকত্ব, চৌম্বক পদার্থের একটি আণবিক ধর্ম। প্রতিটি চৌম্বক পদার্থের প্রতিটি অণুর দুইপ্রান্তে দুইমেরু বিশিষ্ট এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে। এই অণুচুম্বকগুলিকে "ওয়েবার উপাদান (Webwe)" বলে। চৌম্বক পদার্থের চুম্বকত্ব সম্পর্কে ওয়েবারের এই মতবাদকে চুম্বকের আণবিক তত্ত্ব বলে।
(1) ওয়েবারের ধারণা অনুযায়ী সাধারণ অবস্থায় চৌম্বক পদার্থের অণুচুম্বকগুলি চারিদিকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকে। ফলে যেকোনো একটি অণুচুম্বকের মেরুর ক্রিয়া, অপর একটি অণুচুম্বকের মেরুর ক্রিয়াকে প্রশমিত করে। তাই সাধারণ অবস্থায়, চৌম্বক পদার্থের মধ্যে চৌম্বক ধর্ম প্রকাশ করা যায় না।
(2) চৌম্বক পদার্থকে যখন কোনো শক্তিশালী চুম্বকের সাহায্যে বা তড়িৎশক্তির সাহায্যে চুম্বকিত করা হয় তখন পদার্থের অণুচুম্বকগুলি প্রযুক্ত চৌম্বকক্ষেত্রের অভিমুখে পরষ্পর সমান্তরালে সজ্জিত হয়ে যায়। এবং চৌম্বক পদার্থটির মধ্যে চুম্বক ধর্ম প্রকাশিত হয়।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী চৌম্বক পদার্থের ধারণা:
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি চৌম্বক পদার্থের প্রতিটি অনুই এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চুম্বক। কিন্তু অচুম্বকিত অবস্থায় চৌম্বক পদার্থের অণু চুম্বকগুলি বা ওয়েবার উপাদানগুলি পাশাপাশি থেকে বদ্ধমুখ-শৃঙ্খল গঠন করে থাকে। ফলে এক মেরুর ক্রিয়া পাশের বিপরীত মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। এইজন্য চৌম্বক পদার্থের মধ্যে সাধারণ অবস্থায় কোনো চৌম্বক ধর্ম প্রকাশ পায় না।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী চুম্বকন প্রক্রিয়ায় চুম্বকে পরিণত করার ধারণা:
ইংরেজ বিজ্ঞানী এউইং এর তত্ত্ব অনুসারে, কোনো চৌম্বক পদার্থের মধ্যে অণুচুম্বকগুলি বদ্ধমুখ শৃঙ্খলে সাজানো থাকে। এখন ঘর্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বা বৈদ্যুতিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করার সময়, প্রত্যেকটি অণুচুম্বকের উত্তর মেরুগুলি একদিকে এবং দক্ষিণ মেরুগুলি বিপরীতদিকে ঘোরানো হয়। এই অবস্থায় চুম্বকের ভেতরের প্রতিটি অণু চুম্বকের উত্তরমেরু ঠিক পাশের অণুচুম্বকের দক্ষিন মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু একেবারে দুইপ্রান্তের মুক্ত মেরুগুলির সামনে কোনো বিপরীত মেরু না থাকায় ওই মেরুগুলি সক্রিয় থাকে। এই অবস্থায় চুম্বকটির যে প্রান্তে অণুচুম্বকের উত্তরমেরুগুলি থাকে, সেই প্রান্তে চুম্বকের উত্তর মেরু এবং যে প্রান্তে অণু চুম্বকের দক্ষিন মেরুগুলি থাকে, সেই প্রান্তে চুম্বকের দক্ষিনমেরুর সৃষ্টি হয়। এবং চৌম্বক পদার্থটি চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী উদাসীন অঞ্চলের ধারণা:
এখন ঘর্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বা বৈদ্যুতিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো চৌম্বক পদার্থকে চুম্বকে পরিণত করার সময়, প্রত্যেকটি অণুচুম্বকের উত্তর মেরুগুলি একদিকে এবং দক্ষিণ মেরুগুলি বিপরীতদিকে ঘোরানো হয়। এই অবস্থায় চুম্বকের ভেতরের প্রতিটি অণু চুম্বকের উত্তরমেরু ঠিক পাশের অণুচুম্বকের দক্ষিন মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। কিন্তু একেবারে দুইপ্রান্তের মুক্ত মেরুগুলির সামনে কোনো বিপরীত মেরু না থাকায় শুধুমাত্র ওই মেরুগুলি সক্রিয় থাকে। তাই কোনো চুম্বকের প্রান্ত থেকে যত মাঝের দিকে যাওয়া যায়, আকর্ষণ ক্ষমতা ততই কমতে থাকে। চুম্বকের একেবারে মাঝখানে আকর্ষণ ক্ষমতা প্রায় থাকেই না বল্লেই চলে। কোনো চুম্বকের মধ্যবর্তী স্থানের এই অঞ্চলকে উদাসীন অঞ্চল বলে।
আণবিক তত্ত্ব অনুযায়ী কোনো চুম্বকের মেরু একেবারে প্রান্তে অবস্থান করে না:
আমরা জানি কোনো চুম্বকের দুইপ্রান্তে আকর্ষণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এবং প্রান্ত থেকে যত মাঝের দিকে যাওয়া যায় আকর্ষণ ক্ষমতা ততই কমতে থাকে। চুম্বকের একেবারে মাঝখানে আকর্ষণ ক্ষমতা প্রায় থাকেই না। এর কারণ দন্ড চুম্বকের মধ্যে মধ্যে অণু চুম্বকের সারিগুলির দুইপ্রান্তের মুক্ত সমমেরুগুলি নিজেদের মধ্যে বিকর্ষণের ফলে পরষ্পর থেকে যতটা সমভব দূরে সরে যায়। ফলে চুম্বকের মধ্যে অণুচুম্বকের সারিগুলি সরলরেখায় না থেকে বক্ররেখায় সজ্জিত হয়। এই ধরণের বিন্যাসের ফলে মুক্ত মেরুগুলি কেবল চুম্বকের দুপ্রান্তে না থেকে ধারেও একটু ছড়িয়ে থাকে। এইজন্যে চুম্বকের ধারেও আকর্ষণ ক্ষমতা জন্মায়। এই কারণে দন্ডচুম্বকের মেরু, দন্ডের একেবারে প্রান্তে অবস্থিত না হয়ে প্রান্তের কাছাকাছি কোনো বিন্দুতে অবস্থিত হয়।
ভূ-চুম্বকত্ব (Terrestrial Magnetism):
আমরা জানি, মুক্ত অবস্থায় ঝোলানো কোনো চুম্বক বা চুম্বক শলাকা সর্বদা উত্তর দক্ষিন মুখ করে থাকে। শলাকাটিকে আবার নাড়িয়ে দিলে কিছুক্ষন আন্দোলনের পর পূনরায় পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় সর্বত্রই এরকম আচরণ লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় যেন কোনো আকর্ষণ বলের জন্য চুম্বক শলাকা ওইরূপ নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে থাকে।
এই ঘটনা লক্ষ্য করে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথের চিকিৎসক ডাঃ গিলবার্ট মত প্রকাশ করেন যে, পৃথিবী নিজেই একটি বিরাট চুম্বক। কারণ হিসাবে তিনি বলেন চুম্বক শলাকাকে প্রভাবিত করতে পারে একমাত্র চুম্বকই। যেহেতু চতুর্দিকে অন্য কোথাও চুম্বক নেই, তাই পৃথিবীর নিজ চৌম্বকক্ষেত্রের জন্যেই শলাকাটি এরূপ আচরণ করে। অবশ্য পরে তিনি চুম্বক দিয়ে গোলক তৈরি করে তার নিকট ছোটো ছোটো চুম্বক শলাকা বিভিন্ন জায়গায় রেখে পরীক্ষা করে দেখান যে, পৃথিবীর সাথে এর যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে।
একটি দন্ডচুম্বকের মাঝখানে পাকহীন সুতো দিয়ে বেঁধে বাধাহীন অবস্থায় ঝুলিয়ে দিলে চুম্বকটি সর্বদা উত্তর দক্ষিনে মুখ করে স্থির থাকে। চুম্বকটিকে পুনরায় নাড়িয়ে ছেড়ে দিলে এটি কয়েকবার এদিক ওদিক ঘুরে আবার আগের মতোই উত্তর-দক্ষিন মুখ করে দাঁড়ায়। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, নিশ্চয়ই কোনো বাহ্যিক আকর্ষণ বলের প্রভাবে মুক্ত অবস্থায় ঝোলানো চুম্বকটি সর্বদা উত্তর দক্ষিন দিকে মুখ করে থাকে।
এই ঘটনা দেখে 1660 সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী গিলবার্ট সর্বপ্রথম সিদ্ধান্ত করেন যে, পৃথিবী নিজেই একটি বিরাট চুম্বক এবং সাধারণ চুম্বকের মতো পৃথিবীরও দুটি মেরু আছে। একেই ভূ-চুম্বক বলে।
পৃথিবী নিজেই একটি বিরাট চুম্বক তার স্বপক্ষে যুক্তি:
(1) পৃথিবীর মেরু অঞ্চল ছাড়া যেকোনো স্থানে একটি দন্ডচুম্বককে তার ভারকেন্দ্র থেকে বাধাহীনভাবে ঝুলিয়ে দেওয়া হলে তা সর্বদাই উত্তর দক্ষিন মুখ করে থাকে। চুম্বকটিকে সাম্যাবস্থান থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটিয়ে ছেড়ে দিলেও কিছুক্ষণ আন্দোলিত হওয়ার পর তা আবার আগের অবস্থানেই ফিরে আসে। মেরু অঞ্চলে চুম্বকটি সর্বদাই উল্লম্বভাবে থাকে। সুতরাং পরীক্ষাধীন চুম্বকটি নিশ্চই কোনো চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত।
(2) ভূ-পৃষ্ঠের কোনো স্থানে চৌম্বক পদার্থ (লোহা, নিকেল বা কোবাল্ট) জাতীয় অয়ঃশ্চৌম্বক পদার্থের দন্ডকে দীর্ঘদিন উল্লম্বভাবে বা উত্তর দক্ষিন বরাবর পুঁতে রাখলে তার মধ্যে ক্ষীণ চুম্বকত্বের সৃষ্টি হয়।
(3) ভূ-পৃষ্ঠের কাছ দিয়ে কোনো উড়োজাহাজ অনুভূমিকভাবে উড়ে গেলে তার ডানার দুই প্রান্তবিন্দুর মধ্যে একটি বিভবপ্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং এক্ষেত্রে উড়োজাহাজটি নিশ্চয়ই কোনো চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে গতিশীল।
এই কারণগুলির জন্যে পৃথিবীকে একটি বিরাট চুম্বক বলে মনে করা হয়।
সাধারণ চুম্বকের মতোই ভূ-চুম্বকেরও দুটি মেরু আছে। কিন্তু ভূ-চুম্বকের মেরু এবং ভৌগলিক মেরু এক জায়গায় অবস্থিত নয়।
ভূ-চুম্বকের উত্তরমেরুটি, ভৌগলিক উত্তরমেরু থেকে প্রায় 2414 কিলোমিটার পশ্চিমে কানাডার বোথিয়া ফেলিক্স অঞ্চলে অবস্থিত। এই ভূচুম্বকের উত্তর মেরুকে নীল মেরু বলে। এবং
ভূ-চুম্বকের দক্ষিনমেরুটি, ভৌগলিক দক্ষিনমেরু থেকে প্রায় 2250 কিলোমিটার পূর্বে দক্ষিন ভিক্টোরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। এই ভূচুম্বকের দক্ষিন মেরুকে লাল মেরু বলে।
এই ভূ-চুম্বকের উত্তরমেরু এবং ভূ-চুম্বকের দক্ষিন মেরুর সংযোগকারী সরলরেখাকে পৃথিবীর চৌম্বক অক্ষ বলে। পৃথিবীর চৌম্বক অক্ষটি, পৃথিবীর ভৌগলিক অক্ষের সঙ্গে প্রায় 18 ডিগ্রী কোণ করে থাকে।
ভৌগলিক অক্ষ:
ভৌগলিক উত্তর ও দক্ষিন মেরুকে যুক্ত করে একটি সরলরেখা কল্পনা করলে তাকে ভৌগলিক অক্ষ বলে।
ভৌগলিক বিষুবরেখা:
ভৌগলিক অক্ষের কেন্দ্র দিয়ে অক্ষের অভিলম্ব রেখাকে ভৌগলিক বিষুবরেখা বলে।
চৌম্বক অক্ষ:
পৃথিবীর চৌম্বক উত্তরমেরু ও দক্ষিনমেরুকে যুক্ত করে একটি সরলরেখা কল্পনা করলে তাকে চৌম্বক অক্ষ বলে।
চৌম্বক বিষুবরেখা:
চৌম্বক অক্ষের কেন্দ্র দিয়ে অক্ষের অভিলম্ব রেখাকে চৌম্বক বিষুবরেখা বলে।
কয়েকটি অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন:
ওয়েবারের উপাদান কি?
কোনো একটি চুম্বককে বারবার বিভাজন করলে, যে ক্ষুদ্রতম বিভাজিত অংশ পাওয়া যায়, সেটিও একটি ক্ষুদ্র চুম্বক। এইরূপ চুম্বককে অণুচুম্বক বলে। বিজ্ঞানী ওয়েবারের নাম অনুসারে এই অণুচুম্বকগুলিকে ওয়েবারের উপাদান বলা হয়।
ইউইং শৃঙ্খল কাকে বলে?
চৌম্বক পদার্থের মধ্যে ওয়েবারের উপাদানগুলি এলোমেলো ভাবে বিশৃঙ্খল অবস্থায় সাজানো থাকায়, একটি অণুচুম্বকের কোনো একটি মেরু অপর অণুচুম্বকের বিপরীত মেরু দ্বারা প্রশমিত হয়ে যায়। এর ফলে কোনো মুক্ত মেরু থাকে না। এইরূপ বদ্ধমুখ শৃঙ্খলকে ইউইং শৃঙ্খল বলে।
ভূ-চৌম্বক মূলরাশি কাকে বলে?
পৃথিবীর কোনও একটি স্থানের ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য যেসব ভৌতরাশিগুলি ব্যবহার করা হয়, সেই রাশিগুলিকে ভূ-চুম্বকের মূলরাশি বলে। যেমন, বিনতি কোণ, বিচ্যুতি কোণ এবং ভূ-চুম্বকক্ষেত্রের অণুভূমিক উপাংশ।
কোনো একটি চুম্বকের দুটি মেরুর মধ্যে মূল সাদৃশ্য কি?
কোনও একটি নির্দিষ্ট চুম্বকের দুটি মেরুর শক্তি সর্বদা সমান হয়।
চুম্বকের মেরুশক্তির একক কি?
চুম্বকের মেরুশক্তির একক হল: অ্যাম্পিয়ার-মিটার (A-m)
তড়িতের প্রভাবে কোনও চুম্বকের চুম্বকত্বের কি পরিবর্তন হতে পারে?
কোনো চুম্বকের গায়ে অন্তরিত তামার তার জড়িয়ে তার মধ্য দিয়ে পরিবর্তী তড়িৎপ্রবাহ (A.C Current) চালনা করা হলে, ওই চুম্বকটির চুম্বকত্ব হ্রাস পায় বা নষ্টও হয়ে যেতে পারে।
কোন্ ব্যবস্থা অবলম্বন করে সমুদ্রের ঢেউয়ের জন্য জাহাজের আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও নৌকম্পাসের কাঁটাকে অনুভূমিক রাখা হয়?
গিমবল ব্যবস্থা অবলম্বন করে সমুদ্রের ঢেউয়ের ফলে জাহাজের আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও নৌকম্পাসের কাঁটাকে অনুভূমিক রাখা হয়।
হিউস্লার সংকর (Hausler alloy) ধাতু কি?
হিউস্লার সংকর ধাতু হল তামা, অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের তৈরী একপ্রকার সংকর ধাতু। এই সংকর ধাতুটি একটি চৌম্বক পদার্থ। অর্থাৎ লোহা, নিকেল, কোবাল্টের মতো এই হিউস্লার সংকর ধাতুটিও চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয়। এই হিউস্লার সংকর ধাতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে - এর উপাদান মৌল ধাতুগুলি অচৌম্বক পদার্থ হলেও, এদের মিশ্রণে উৎপাদিত সংকর ধাতুটি একটি চৌম্বক পদার্থ।
হ্যাডফিল্ড ম্যাঙ্গানিজ স্টীল কি?
লোহা ও ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রণে উৎপাদিত সংকর ধাতু হ্যাডফিল্ড ম্যাঙ্গানিজ স্টিল একটি অচৌম্বক পদার্থ। এই সংকর ধাতুটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল - এর একটি উপাদান মৌল লোহা চৌম্বক পদার্থ হলেও, লোহা ও ম্যাঙ্গানিজের মিশ্রনে উৎপাদিত সংকর ধাতু হ্যাডফিল্ড ম্যাঙ্গানিজ স্টিল একটি অচৌম্বক পদার্থ।
লাল মেরু ও নীল মেরু কাকে বলা হয়?
পৃথিবীর চৌম্বক দক্ষিন মেরুকে লাল মেরু বলে। এটি পৃথিবীর ভৌগলিক দক্ষিন মেরু থেকে 2250 কিমি পূর্বে দক্ষিন ভিক্টোরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। আবার পৃথিবীর চৌম্বক উত্তর মেরুকে নীল মেরু বলে। এটি পৃথিবীর ভৌগলিক উত্তর মেরু থেকে প্রায় 2414 কিমি পশ্চিমে কানাডার বোথিয়াফেলিক্স অঞ্চলে অবস্থিত।