রাসায়নিক বিক্রিয়া (Chemical Reaction):
যে প্রক্রিয়ায় এক বা একাধিক পদার্থের আণবিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে এক বা একাধিক সম্পূর্ণ নতুন আনবিক গঠনের পদার্থ সৃষ্টি হয় তাকে রাসায়নিক বিক্রিয়া বলা হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে একটি পদার্থ সম্পূর্ণ নতুন ধর্মবিশিষ্ট অন্য একটি পদার্থে পরিণত হয়, কিন্তু পদার্থের মূল উপাদান ও পরমাণুর সংখ্যার কোনও পরিবর্তন ঘটে না।
নিম্নে কয়েকটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার উদাহরণ দেওয়া হল।
(1) সোডিয়াম জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
(2) হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন গ্যাসের মিশ্রণকে আলোতে রাখলে গ্যাস দুটি রাসায়নিক বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস উৎপন্ন করে।
(3) পটাশিয়াম ক্লোরেটকে তাপ দিলে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।
(4) ফসফরাস ও অক্সিজেনের বিক্রিয়া করে ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড উৎপন্ন হয়।
(5) নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন পরস্পর বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়।
বিক্রিয়ক পদার্থ (Reactants): যে পদার্থ বা পদার্থগুলি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, তাদের বিক্রিয়াশীল পদার্থ বা বিকারক বা বিক্রিয়ক পদার্থ বলে।
এখানে,
(1) নং বিক্রিয়াটিতে সোডিয়াম ও জল হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(2) নং বিক্রিয়াটিতে হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(3) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র পটাশিয়াম ক্লোরেট হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(4) নং বিক্রিয়াটিতে ফসফরাস ও অক্সিজেন হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(5) নং বিক্রিয়াটিতে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন হল বিক্রিয়ক পদার্থ
বিক্রিয়াজাত পদার্থ (Products):
রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে নতুন ধর্মবিশিষ্ট যে সব পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাদের বিক্রিয়াজাত পদার্থ বলে।
এখানে,
(1) নং বিক্রিয়াটিতে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(2) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(3) নং বিক্রিয়াটিতে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেন গ্যাস হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(4) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(5) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র অ্যামোনিয়া হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
নিম্নে কয়েকটি রাসায়নিক বিক্রিয়া দেওয়া হল। এই রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি থেকে এখানে নিম্নলিখিত তালিকার মতো একটি বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের তালিকা তৈরি করো:
3 নাইট্রোজেন + হাইড্রোজেন (নির্দিষ্ট চাপ ও তাপমাত্রা) → অ্যামোনিয়া
4 ক্যালশিয়াম কার্বনেট (তাপ) → ক্যালশিয়াম অক্সাইড + কার্বন ডাইঅক্সাইড
5 সিলভার ক্লোরাইড (আলো) → সিলভার + ক্লোরিন
6 পটাশিয়াম ক্লোরেট (তাপ) → পটাশিয়াম ক্লোরাইড + অক্সিজেন
7 ম্যাগনেশিয়াম + অক্সিজেন (তাপ) → ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড
8 নাইট্রিক অক্সাইড + অক্সিজেন (সংস্পর্শ) → নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড
9 সালফার ডাইঅক্সাইড + অক্সিজেন (বিশেষ শর্তে সংস্পর্শ) → সালফার ট্রাইঅক্সাইড
10 আয়রন + জলীয় বাষ্প → ফেরিক অক্সাইড + হাইড্রোজেন
11 পটাশিয়াম নাইট্রেট (তাপ) → পটাশিয়াম নাইট্রাইট + অক্সিজেন
12 অ্যালুমিনিয়াম + অক্সিজেন (সংস্পর্শ) → অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড
13 ম্যাগনেশিয়াম + নাইট্রোজেন (দহন) → ম্যাগনেশিয়াম নাইট্রাইড
14 অ্যামোনিয়া + অক্সিজেন → নাইট্রোজেন + জল
15 অ্যামোনিয়া + ক্লোরিন → অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড + নাইট্রোজেন
16 ক্যালশিয়াম কার্বনেট + হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (সংস্পর্শ) → ক্যালশিয়াম ক্লোরাইড + কার্বন ডাইঅক্সাইড
17 ম্যাগনেশিয়াম + কার্বন ডাইঅক্সাইড (দহন) → ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড + কার্বন
18 কপার + সালফিউরিক অ্যাসিড → কপার সালফেট + জল + সালফার ডাইঅক্সাইড
19 সোডিয়াম + জল → সোডিয়াম অক্সাইড + হাইড্রোজেন
এখানে উপরের উদাহরণে যে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি বলা হল, তা শুধু বিক্রিয়ক পদার্থগুলি সংস্পর্শে আসামাত্র রাসায়নিক বিক্রিয়াটি সংঘটিত হয় তা কিন্তু সবসময় হয় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিক্রিয়ক পদার্থগুলি উপযুক্ত বিভিন্ন শর্তে যেমন, চাপ, তাপ, বিদ্যুৎ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। তা পরে আলোচনা করা হবে।
রাসায়নিক বিক্রিয়া(Chemical Reaction):
আমরা উপরের কয়েকটি উদাহরণে কয়েকটি রাসায়নিক বিক্রিয়া দেখলাম।
(1) সোডিয়াম জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
(2) হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন গ্যাসের মিশ্রণকে আলোতে রাখলে গ্যাস দুটি রাসায়নিক বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস উৎপন্ন করে।
(3) পটাশিয়াম ক্লোরেটকে তাপ দিলে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।
(4) ফসফরাস ও অক্সিজেনের বিক্রিয়া করে ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড উৎপন্ন হয়।
(5) নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন পরস্পর বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয়।
এখন এই পরিবর্তনগুলিকে লিখিত আকারে ও সহজে প্রকাশ করার জন্য আমরা Word Equation এর সাহায্য নিয়ে লিখেছি। যেমন,
সোডিয়াম + জল → সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড + হাইড্রোজেন
হাইড্রোজেন + ক্লোরিন হাইড্রোজেন ক্লোরাইড
পটাশিয়াম ক্লোরেট → পটাশিয়াম ক্লোরাইড + অক্সিজেন
ফসফরাস + অক্সিজেন → ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড
নাইট্রোজেন + হাইড্রোজেন → অ্যামোনিয়া
এই Word Equation কে আরও অর্থপূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় Chemical Equation বা রাসায়নিক সমীকরণ।
রাসায়নিক সমীকরণ (Chemical Equation):
কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে চিহ্ন ও সংকেতের সাহায্যে বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের পরমাণুগুলির মধ্যে সমতা বজায় রেখে সংক্ষেপে প্রকাশ করার পদ্ধতিকে রাসায়নিক সমীকরণ বলে। এককথায় রাসায়নিক পরিবর্তনের সময় কার্যত যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তারই সাংকেতিক রূপ হল রাসায়নিক সমীকরণ।
রাসায়নিক সমীকরণ লেখার নিয়ম (How you write Chemical Equation):
(1) প্রথমে বিক্রিয়া সংক্রান্ত বক্তব্যটিকে Word Equation এর আকারে লিখে নেওয়া উচিত।
(2) তারপর পরমাণু হলে চিহ্ন এবং অণু হলে সংকেতের সাহায্যে বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলিকে লেখা হয় ও বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থ বা পদার্থগুলির মাঝে তীর চিহ্ন বসানো হয়।
(3) বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলি একাধিক থাকলে, বিক্রিয়ক পদার্থের সংকেতগুলিকে “+” চিহ্ন দিয়ে এবং বিক্রিয়াজাত পদার্থের সংকেতগুলিকেও “+” চিহ্ন দিয়ে লেখা হয়।
(4) বামদিকের যোগ চিহ্নগুলি কোন্ কোন্ অণুর মধ্যে বিক্রিয়া ঘটছে তা প্রকাশ করে এবং ডানদিকের যোগ চিহ্নগুলি, বিক্রিয়ার ফলে কি কি পদার্থ উৎপন্ন হল তা প্রকাশ করে।
(5) এবার বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের মধ্যে পরমাণুর সংখ্যা সমান করার জন্য Balance (সমতাবিধান করা) করে নিতে হয়।
(6) সমতাবিধান করার পর বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির মধ্যের তীরচিহ্নটিকে উঠিয়ে “=” বসানো হলে রাসায়নিক সমীকরণটি সম্পূর্ণ হয়। তবে বর্তমান মতে এই “=” চিহ্ন ব্যবহার আর করা হয় না। কারণ এই তীর চিহ্নকেই রেখে দেওয়া হয় কারন এই তীরচিহ্নের সাহায্যে বিক্রিয়াটির অভিমুখ আমরা বুঝতে পারি। কারন বিক্রিয়াটি একমুখী হলে “→” এবং বিক্রিয়াটি উভমুখী হলে “⇄” বা “⇌” ব্যবহার করা হয়। এখানে কিন্তু ভালো করে মনে রাখা প্রয়োজন এই রাসায়নিক সমীকরণ কিন্তু বীজগনিতের সমীকরণ নয়।
উদাহরণ: 1
সোডিয়াম + জল → সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড + হাইড্রোজেন
Na+H2O→NaOH+H2↑
2Na+2H2O=2NaOH+H2↑
উদাহরণ: 2
হাইড্রোজেন + ক্লোরিন → হাইড্রোজেন ক্লোরাইড
H2+Cl2→HCl
H2+Cl2=2HCl↑
উদাহরণ: 3
পটাশিয়াম ক্লোরেট → পটাশিয়াম ক্লোরাইড + অক্সিজেন
KClO3→KCl+O2↑
2KClO3=2KCl+3O2↑
উদাহরণ: 4
ফসফরাস + অক্সিজেন → ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড
P4+5O2→P2O5
P4+5O2=2P2O5
উদাহরণ: 5
নাইট্রোজেন + হাইড্রোজেন → অ্যামোনিয়া
N2+H2→NH3
N2+3H2=2NH3
চিহ্ন (Symbol), সংকেত (Formula) এবং রাসায়নিক সমীকরনের (Chemical Equation) তাৎপর্য: (Significance of Symbol, Formula and Chemical Equation):
চিহ্নের তাৎপর্য:
চিহ্নের দ্বারা আমরা কোনো মৌলের পরমাণুকে সংক্ষেপে প্রকাশ করি।
সংকেতের তাৎপর্য:
সংকেতের দ্বারা আমরা কোনো মৌল বা যৌগের অণুকে সংক্ষেপে প্রকাশ করি।
রাসায়নিক সমীকরণের তাৎপর্য:
রাসায়নিক সমীকরণের দ্বারা আমরা কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে সংক্ষেপে প্রকাশ করি।
রাসায়নিক সমীকরণের সমতাবিধান করার প্রয়োজনীয়তা:
একটি বিক্রিয়া যতই জটিল হোক না কেন, বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া অনুধাবনের পর জানা গেছে যে (i) বিক্রিয়ক পদার্থের মোট ভর ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের মোট ভরের সমান হয়। এটি ভরের নিত্যতা সূত্র। অর্থাৎ ভর নষ্ট বা ধ্বংস হয় না এবং নতুনভাবে সৃষ্টিও হতে পারে না। ভর সর্বদা নিত্যতা সূত্র মেনে চলে। এবং (ii) ডালটনের পরমাণুবাদ থেকে জানতে পারি যে, পরমাণু অবিভাজ্য এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর সৃষ্টি বা ধ্বংস সম্ভব নয়। তাই বামদিকের বিক্রিয়ক পদার্থগুলির পরমাণুর মোটসংখ্যা এবং ডানদিকের বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির পরমাণুর মোট সংখ্যা হবেই।
সেইজন্যই পরমাণুগুলির সংখ্যার সমতা বিধানের জন্য বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির মধ্যে অনুর সংখ্যা বাড়িয়ে উভয়পাশেই পরমাণুর সংখ্যাকে সমান করতে হয়। একেই সমতাবিধান (Balance) করা বলে।
রাসায়নিক সমীকরণের সমতাবিধান করার কৌশল:
(1) পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি (Trial-error Method): বামদিকে বিক্রিয়ক ও ডানদিকে বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির অণুর সংকেত লেখা হয় এবং মাঝখানে তীরচিহ্ন বসানো হয়। এবার এই বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির সংকেতের বামপাশে উপযুক্ত পূর্ণসংখ্যা বসিয়ে বাম ও ডানদিকের পদার্থের মধ্যে পরমাণুর সংখ্যা সমান করা হয়।
(2) বীজগানিতিক সমীকরণের সাহায্যে (Using Algebraic Equation):
রাসায়নিক সমীকরণে তীরচিহ্নের উভয়পার্শ্বে পরমাণুর সংখ্যা সমান হবেই – এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বীজগনিতের সমীকরণ গঠন করে সমাধান করে ব্যালেন্স করা হয়। এই পদ্ধতি একটু সময়সাপেক্ষ কিন্তু নির্ভূল এবং সফল হবেই।
এর পরবর্তী Part: 5 অংশে বীজগাণিতিক পদ্ধতি আলোচনা করা হল।
যে প্রক্রিয়ায় এক বা একাধিক পদার্থের আণবিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে এক বা একাধিক সম্পূর্ণ নতুন আনবিক গঠনের পদার্থ সৃষ্টি হয় তাকে রাসায়নিক বিক্রিয়া বলা হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে একটি পদার্থ সম্পূর্ণ নতুন ধর্মবিশিষ্ট অন্য একটি পদার্থে পরিণত হয়, কিন্তু পদার্থের মূল উপাদান ও পরমাণুর সংখ্যার কোনও পরিবর্তন ঘটে না।
নিম্নে কয়েকটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার উদাহরণ দেওয়া হল।
(1) সোডিয়াম জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
(2) হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন গ্যাসের মিশ্রণকে আলোতে রাখলে গ্যাস দুটি রাসায়নিক বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস উৎপন্ন করে।
(3) পটাশিয়াম ক্লোরেটকে তাপ দিলে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।
(4) ফসফরাস ও অক্সিজেনের বিক্রিয়া করে ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড উৎপন্ন হয়।
(5) নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন পরস্পর বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়।
বিক্রিয়ক পদার্থ (Reactants): যে পদার্থ বা পদার্থগুলি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, তাদের বিক্রিয়াশীল পদার্থ বা বিকারক বা বিক্রিয়ক পদার্থ বলে।
এখানে,
(1) নং বিক্রিয়াটিতে সোডিয়াম ও জল হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(2) নং বিক্রিয়াটিতে হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(3) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র পটাশিয়াম ক্লোরেট হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(4) নং বিক্রিয়াটিতে ফসফরাস ও অক্সিজেন হল বিক্রিয়ক পদার্থ
(5) নং বিক্রিয়াটিতে নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন হল বিক্রিয়ক পদার্থ
বিক্রিয়াজাত পদার্থ (Products):
রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে নতুন ধর্মবিশিষ্ট যে সব পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাদের বিক্রিয়াজাত পদার্থ বলে।
এখানে,
(1) নং বিক্রিয়াটিতে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(2) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(3) নং বিক্রিয়াটিতে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেন গ্যাস হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(4) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
(5) নং বিক্রিয়াটিতে শুধুমাত্র অ্যামোনিয়া হল বিক্রিয়াজাত পদার্থ
নিম্নে কয়েকটি রাসায়নিক বিক্রিয়া দেওয়া হল। এই রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি থেকে এখানে নিম্নলিখিত তালিকার মতো একটি বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের তালিকা তৈরি করো:
ক্রমিক নং | রাসায়নিক বিক্রিয়া (Chemical Reaction) | বিক্রিয়ক পদার্থ (Reagent) | বিক্রিয়াজাত পদার্থ (Products) |
1 | ফসফরাস + অক্সিজেন (দহন) → ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড | ফসফরাস ও অক্সিজেন | ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড |
2 | লোহা + জলীয়বাষ্প → ফেরোসোফেরিক অক্সাইড + হাইড্রোজেন | লোহা ও জলীয়বাষ্প | ফেরোসোফেরিক অক্সাইড ও হাইড্রোজেন |
3 নাইট্রোজেন + হাইড্রোজেন (নির্দিষ্ট চাপ ও তাপমাত্রা) → অ্যামোনিয়া
4 ক্যালশিয়াম কার্বনেট (তাপ) → ক্যালশিয়াম অক্সাইড + কার্বন ডাইঅক্সাইড
5 সিলভার ক্লোরাইড (আলো) → সিলভার + ক্লোরিন
6 পটাশিয়াম ক্লোরেট (তাপ) → পটাশিয়াম ক্লোরাইড + অক্সিজেন
7 ম্যাগনেশিয়াম + অক্সিজেন (তাপ) → ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড
8 নাইট্রিক অক্সাইড + অক্সিজেন (সংস্পর্শ) → নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড
9 সালফার ডাইঅক্সাইড + অক্সিজেন (বিশেষ শর্তে সংস্পর্শ) → সালফার ট্রাইঅক্সাইড
10 আয়রন + জলীয় বাষ্প → ফেরিক অক্সাইড + হাইড্রোজেন
11 পটাশিয়াম নাইট্রেট (তাপ) → পটাশিয়াম নাইট্রাইট + অক্সিজেন
12 অ্যালুমিনিয়াম + অক্সিজেন (সংস্পর্শ) → অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড
13 ম্যাগনেশিয়াম + নাইট্রোজেন (দহন) → ম্যাগনেশিয়াম নাইট্রাইড
14 অ্যামোনিয়া + অক্সিজেন → নাইট্রোজেন + জল
15 অ্যামোনিয়া + ক্লোরিন → অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড + নাইট্রোজেন
16 ক্যালশিয়াম কার্বনেট + হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (সংস্পর্শ) → ক্যালশিয়াম ক্লোরাইড + কার্বন ডাইঅক্সাইড
17 ম্যাগনেশিয়াম + কার্বন ডাইঅক্সাইড (দহন) → ম্যাগনেশিয়াম অক্সাইড + কার্বন
18 কপার + সালফিউরিক অ্যাসিড → কপার সালফেট + জল + সালফার ডাইঅক্সাইড
19 সোডিয়াম + জল → সোডিয়াম অক্সাইড + হাইড্রোজেন
এখানে উপরের উদাহরণে যে রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি বলা হল, তা শুধু বিক্রিয়ক পদার্থগুলি সংস্পর্শে আসামাত্র রাসায়নিক বিক্রিয়াটি সংঘটিত হয় তা কিন্তু সবসময় হয় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিক্রিয়ক পদার্থগুলি উপযুক্ত বিভিন্ন শর্তে যেমন, চাপ, তাপ, বিদ্যুৎ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। তা পরে আলোচনা করা হবে।
রাসায়নিক বিক্রিয়া(Chemical Reaction):
আমরা উপরের কয়েকটি উদাহরণে কয়েকটি রাসায়নিক বিক্রিয়া দেখলাম।
(1) সোডিয়াম জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
(2) হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন গ্যাসের মিশ্রণকে আলোতে রাখলে গ্যাস দুটি রাসায়নিক বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাস উৎপন্ন করে।
(3) পটাশিয়াম ক্লোরেটকে তাপ দিলে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ও অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।
(4) ফসফরাস ও অক্সিজেনের বিক্রিয়া করে ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড উৎপন্ন হয়।
(5) নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন পরস্পর বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয়।
এখন এই পরিবর্তনগুলিকে লিখিত আকারে ও সহজে প্রকাশ করার জন্য আমরা Word Equation এর সাহায্য নিয়ে লিখেছি। যেমন,
সোডিয়াম + জল → সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড + হাইড্রোজেন
হাইড্রোজেন + ক্লোরিন হাইড্রোজেন ক্লোরাইড
পটাশিয়াম ক্লোরেট → পটাশিয়াম ক্লোরাইড + অক্সিজেন
ফসফরাস + অক্সিজেন → ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড
নাইট্রোজেন + হাইড্রোজেন → অ্যামোনিয়া
এই Word Equation কে আরও অর্থপূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করা হয় Chemical Equation বা রাসায়নিক সমীকরণ।
রাসায়নিক সমীকরণ (Chemical Equation):
কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে চিহ্ন ও সংকেতের সাহায্যে বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের পরমাণুগুলির মধ্যে সমতা বজায় রেখে সংক্ষেপে প্রকাশ করার পদ্ধতিকে রাসায়নিক সমীকরণ বলে। এককথায় রাসায়নিক পরিবর্তনের সময় কার্যত যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তারই সাংকেতিক রূপ হল রাসায়নিক সমীকরণ।
রাসায়নিক সমীকরণ লেখার নিয়ম (How you write Chemical Equation):
(1) প্রথমে বিক্রিয়া সংক্রান্ত বক্তব্যটিকে Word Equation এর আকারে লিখে নেওয়া উচিত।
(2) তারপর পরমাণু হলে চিহ্ন এবং অণু হলে সংকেতের সাহায্যে বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলিকে লেখা হয় ও বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থ বা পদার্থগুলির মাঝে তীর চিহ্ন বসানো হয়।
(3) বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলি একাধিক থাকলে, বিক্রিয়ক পদার্থের সংকেতগুলিকে “+” চিহ্ন দিয়ে এবং বিক্রিয়াজাত পদার্থের সংকেতগুলিকেও “+” চিহ্ন দিয়ে লেখা হয়।
(4) বামদিকের যোগ চিহ্নগুলি কোন্ কোন্ অণুর মধ্যে বিক্রিয়া ঘটছে তা প্রকাশ করে এবং ডানদিকের যোগ চিহ্নগুলি, বিক্রিয়ার ফলে কি কি পদার্থ উৎপন্ন হল তা প্রকাশ করে।
(5) এবার বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের মধ্যে পরমাণুর সংখ্যা সমান করার জন্য Balance (সমতাবিধান করা) করে নিতে হয়।
(6) সমতাবিধান করার পর বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির মধ্যের তীরচিহ্নটিকে উঠিয়ে “=” বসানো হলে রাসায়নিক সমীকরণটি সম্পূর্ণ হয়। তবে বর্তমান মতে এই “=” চিহ্ন ব্যবহার আর করা হয় না। কারণ এই তীর চিহ্নকেই রেখে দেওয়া হয় কারন এই তীরচিহ্নের সাহায্যে বিক্রিয়াটির অভিমুখ আমরা বুঝতে পারি। কারন বিক্রিয়াটি একমুখী হলে “→” এবং বিক্রিয়াটি উভমুখী হলে “⇄” বা “⇌” ব্যবহার করা হয়। এখানে কিন্তু ভালো করে মনে রাখা প্রয়োজন এই রাসায়নিক সমীকরণ কিন্তু বীজগনিতের সমীকরণ নয়।
উদাহরণ: 1
সোডিয়াম + জল → সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড + হাইড্রোজেন
Na+H2O→NaOH+H2↑
2Na+2H2O=2NaOH+H2↑
উদাহরণ: 2
হাইড্রোজেন + ক্লোরিন → হাইড্রোজেন ক্লোরাইড
H2+Cl2→HCl
H2+Cl2=2HCl↑
উদাহরণ: 3
পটাশিয়াম ক্লোরেট → পটাশিয়াম ক্লোরাইড + অক্সিজেন
KClO3→KCl+O2↑
2KClO3=2KCl+3O2↑
উদাহরণ: 4
ফসফরাস + অক্সিজেন → ফসফরাস পেন্টঅক্সাইড
P4+5O2→P2O5
P4+5O2=2P2O5
উদাহরণ: 5
নাইট্রোজেন + হাইড্রোজেন → অ্যামোনিয়া
N2+H2→NH3
N2+3H2=2NH3
চিহ্ন (Symbol), সংকেত (Formula) এবং রাসায়নিক সমীকরনের (Chemical Equation) তাৎপর্য: (Significance of Symbol, Formula and Chemical Equation):
চিহ্নের তাৎপর্য:
চিহ্নের দ্বারা আমরা কোনো মৌলের পরমাণুকে সংক্ষেপে প্রকাশ করি।
সংকেতের তাৎপর্য:
সংকেতের দ্বারা আমরা কোনো মৌল বা যৌগের অণুকে সংক্ষেপে প্রকাশ করি।
রাসায়নিক সমীকরণের তাৎপর্য:
রাসায়নিক সমীকরণের দ্বারা আমরা কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়াকে সংক্ষেপে প্রকাশ করি।
রাসায়নিক সমীকরণের সমতাবিধান করার প্রয়োজনীয়তা:
একটি বিক্রিয়া যতই জটিল হোক না কেন, বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া অনুধাবনের পর জানা গেছে যে (i) বিক্রিয়ক পদার্থের মোট ভর ও বিক্রিয়াজাত পদার্থের মোট ভরের সমান হয়। এটি ভরের নিত্যতা সূত্র। অর্থাৎ ভর নষ্ট বা ধ্বংস হয় না এবং নতুনভাবে সৃষ্টিও হতে পারে না। ভর সর্বদা নিত্যতা সূত্র মেনে চলে। এবং (ii) ডালটনের পরমাণুবাদ থেকে জানতে পারি যে, পরমাণু অবিভাজ্য এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর সৃষ্টি বা ধ্বংস সম্ভব নয়। তাই বামদিকের বিক্রিয়ক পদার্থগুলির পরমাণুর মোটসংখ্যা এবং ডানদিকের বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির পরমাণুর মোট সংখ্যা হবেই।
সেইজন্যই পরমাণুগুলির সংখ্যার সমতা বিধানের জন্য বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির মধ্যে অনুর সংখ্যা বাড়িয়ে উভয়পাশেই পরমাণুর সংখ্যাকে সমান করতে হয়। একেই সমতাবিধান (Balance) করা বলে।
রাসায়নিক সমীকরণের সমতাবিধান করার কৌশল:
(1) পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি (Trial-error Method): বামদিকে বিক্রিয়ক ও ডানদিকে বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির অণুর সংকেত লেখা হয় এবং মাঝখানে তীরচিহ্ন বসানো হয়। এবার এই বিক্রিয়ক ও বিক্রিয়াজাত পদার্থগুলির সংকেতের বামপাশে উপযুক্ত পূর্ণসংখ্যা বসিয়ে বাম ও ডানদিকের পদার্থের মধ্যে পরমাণুর সংখ্যা সমান করা হয়।
(2) বীজগানিতিক সমীকরণের সাহায্যে (Using Algebraic Equation):
রাসায়নিক সমীকরণে তীরচিহ্নের উভয়পার্শ্বে পরমাণুর সংখ্যা সমান হবেই – এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বীজগনিতের সমীকরণ গঠন করে সমাধান করে ব্যালেন্স করা হয়। এই পদ্ধতি একটু সময়সাপেক্ষ কিন্তু নির্ভূল এবং সফল হবেই।
এর পরবর্তী Part: 5 অংশে বীজগাণিতিক পদ্ধতি আলোচনা করা হল।
No comments:
Post a Comment